কাশ্মীরে আয়োজিত ‘ইন্ডিয়ান হেভেনস প্রিমিয়ার লিগ’ ঘিরে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। টুর্নামেন্টের মাঝপথেই আয়োজকেরা হোটেলের বিল না মিটিয়েই পালিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন বিশ্ব তারকা ক্রিস গেইল, থিসারা পেরেরা, এমনকি বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানও ছিলেন অংশগ্রহণের তালিকায়।
কাশ্মীরের শ্রীনগরে আয়োজিত ইন্ডিয়ান হেভেনস প্রিমিয়ার লিগ (আইএইচপিএল) হঠাৎ করেই চরম বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। হোটেল বিল, খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক এবং আয়োজন সংক্রান্ত বকেয়া না মিটিয়েই আয়োজকেরা হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় টুর্নামেন্টটি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ক্রিস গেইল, থিসারা পেরেরা, জেসি রাইডারসহ বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটাররা। জানা গেছে, এই লিগে বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানেরও খেলার কথা ছিল।
আইএইচপিএল: ভূস্বর্গে শুরু, দুঃস্বপ্নে শেষ
ইন্ডিয়ান হেভেনস প্রিমিয়ার লিগ (আইএইচপিএল) শুরু হয়েছিল ২৫ অক্টোবর, শ্রীনগরের বকশি স্টেডিয়ামে। আটটি দল অংশ নেয় এ টুর্নামেন্টে, যার সমাপ্তি হওয়ার কথা ছিল ৮ নভেম্বর। আয়োজকেরা জানিয়েছিলেন, এই লিগের মাধ্যমে কাশ্মীরের পর্যটন ও স্থানীয় ক্রিকেটকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
তবে বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। টুর্নামেন্টের মাঝপথে, ১ নভেম্বর রাতেই আয়োজকেরা কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই শ্রীনগর ছেড়ে পালিয়ে যান। পরদিন সকালে খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা জানতে পারেন, হোটেলের বিল পরিশোধ করা হয়নি, এমনকি পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়নি।
ক্রিস গেইল-পেরেরাদের বিড়ম্বনা
বিশ্ব ক্রিকেটের তারকা ক্রিস গেইল, থিসারা পেরেরা, জেসি রাইডার এবং রিচার্ড লেভির মতো খেলোয়াড়রা আইএইচপিএলে অংশ নিতে কাশ্মীরে গিয়েছিলেন। কিন্তু আয়োজকদের পালানোর পর তারকারা হোটেলেই আটকা পড়ে যান।
হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, আয়োজকেরা ১৫০টিরও বেশি কক্ষ বুক করেছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্রিস গেইলের মতো তারকা খেলোয়াড়ের উপস্থিতিতে পর্যটন শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু তারা বিল পরিশোধ না করেই উধাও হয়ে যান। ফলে প্রায় ৪০ জন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাকে হোটেলে আটকা অবস্থায় সময় কাটাতে হয়।
সাকিব আল হাসানের নামও ছিল তালিকায়
বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানেরও নাম ছিল এই লিগের তালিকায়। গত ১৫ অক্টোবর আইএইচপিএলের অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রাম পেজে সাকিবকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়, যেখানে তিনি বলেন, টুর্নামেন্টে অংশ নিতে উন্মুখ তিনি। যদিও পরে সাকিব সত্যিই খেলেছেন কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
তবে প্রচারণায় ব্যবহৃত পোস্টার ও ভিডিওতে সাকিবের বড় ছবি দেখা গেছে, যা লিগটিকে ঘিরে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বিদেশি কর্মকর্তাদেরও বিপাকে পড়া
ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) কর্মকর্তা মেলিসা জুনিপার এই টুর্নামেন্টে আম্পায়ার হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তিনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানান, “আয়োজকেরা হোটেল থেকে পালিয়ে গেছেন। আমাদের কাউকে কোনো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। আমরা হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কোনোভাবে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।”
পরে ব্রিটিশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় কয়েকজন বিদেশি খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা নিরাপদে হোটেল ছাড়তে সক্ষম হন।
স্পনসর ও আর্থিক সংকটই মূল কারণ?
স্থানীয় এক ক্রিকেটার জানিয়েছেন, শেষ মুহূর্তে স্পনসরদের সরে যাওয়ায় আয়োজকেরা অর্থ সংকটে পড়েন। ফলে খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক, হোটেল বিলসহ অন্যান্য খরচ মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। টুর্নামেন্টের প্রথম দিনও পোশাকের সংকট দেখা গিয়েছিল বলে জানা যায়, যা স্থানীয়ভাবে কিনে আনতে হয়েছিল।
এছাড়া, কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে লিখিত চুক্তিও সম্পন্ন হয়নি। ফলে আইনগতভাবে তারা দাবি জানাতে পারছেন না।
আয়োজকদের পক্ষের নীরবতা ও তদন্তের দাবি
আইএইচপিএলের আয়োজক সংস্থা “ইউবা সোসাইটি মোহালি” এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। সহযোগী সংস্থা হিসেবে থাকা জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর স্পোর্টস কাউন্সিল জানিয়েছে, তারা কেবল মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে এবং টুর্নামেন্টের অর্থ ব্যবস্থাপনায় তাদের সরাসরি ভূমিকা ছিল না।
তবে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, এই ঘটনার তদন্ত দাবি উঠেছে এবং আয়োজকদের খোঁজে নেমেছে পুলিশ।
দর্শকহীন মাঠ ও ব্যর্থ আয়োজন
সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে ২৫ থেকে ৩০ হাজার দর্শক উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ছিল এর উল্টো ছবি — গ্যালারির বেশিরভাগ আসন ফাঁকা, টিকিট বিক্রি কম, প্রচারণাও দুর্বল।
ফলে লিগের আর্থিক সাফল্য তো দূরের কথা, আয়োজকদের লোকসানও বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সেই চাপেই আয়োজকেরা পালিয়ে যাওয়ার পথ বেছে নেয় বলে ধারণা করছে স্থানীয় গণমাধ্যম।
ভবিষ্যতে কী হবে?
বিশ্বজুড়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে এখন প্রশ্ন উঠছে — এই ধরনের বেসরকারি লিগের প্রতি কি ক্রিকেটারদের আস্থা রাখা উচিত? বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক তারকাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও পেশাদার কাঠামোর অভাবই আইএইচপিএলের ব্যর্থতার মূল কারণ।
এখন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত খেলোয়াড়রা তাদের পাওনা পাবেন কি না, তা অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে।
কাশ্মীরে বড় প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হওয়া আইএইচপিএল শেষ হলো চরম বিশৃঙ্খলা ও বিতর্কে। খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, এমনকি পর্যটন শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এই ব্যর্থ আয়োজন। ক্রিকেটবিশ্বে এটি আবারও মনে করিয়ে দিল— পরিকল্পনা ও স্বচ্ছতা ছাড়া কোনো আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্ট আয়োজন সম্ভব নয়।
এম আর এম – ২০৬৩,Signalbd.com
				
					


