গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন এবং প্রক্রিয়া নির্ধারণকারী প্রধান আইন। সম্প্রতি এর ২০ ধারায় সংশোধনী আনার পর বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। বিশেষ করে জোটভুক্ত নির্বাচনে প্রতীকের বিষয়টি রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণ হয়েছে।
আরপিও: প্রেক্ষাপট
আরপিও বা Representation of the People Order হলো বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচনী আইন, যা ভোটার তালিকা, প্রার্থীর যোগ্যতা, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার নিয়ম, রাজনৈতিক দল ও জোটের কাঠামো এবং নির্বাচন পরিচালনার নির্দেশনা নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় প্রথমবারের মতো আরপিও প্রণয়ন করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময় আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।
সবশেষ ২০২৩ সালে সংসদে পাস হয় গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আইন। আরপিওতে দেশের মানুষের গণঅধিকার, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এবং নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করার নির্দেশনা উল্লেখ থাকে।
সংশোধিত আরপিও এবং নতুন বিধান
২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আরপিওর ২০ ধারায় নতুন সংশোধনী অনুমোদন করেছে। মূল পরিবর্তনগুলো হলো:
- জোটভুক্ত নির্বাচনে প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে।
- সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
- পলাতক আসামিকে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না দেওয়া।
- প্রার্থীর দেশে-বিদেশে সম্পদের বিবরণী বাধ্যতামূলক করা।
- কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা।
- ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান বিলুপ্ত।
- ৫০ হাজার টাকার বেশি চাঁদা বা অনুদান ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন বাধ্যতামূলক।
এই সংশোধনী নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও নিয়মমাফিক করার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির আপত্তি
সংশোধিত আরপিওর জোটভুক্ত নির্বাচনে নিজ দলের প্রতীকে ভোটে অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি-র মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
- বিএনপি: জোটভুক্ত নির্বাচনে শরিক দলগুলোকে অন্য দলের প্রতীকে অংশগ্রহণের পুরনো অধিকার ফেরত চাচ্ছে। দলটি মনে করছে, এই বিধান তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে।
- জামায়াত: বিএনপির দাবিতে জোট শরিককে দলীয় প্রতীক দেয়ার নিয়ম পুনর্বহাল হলে তা মানবে না।
- এনসিপি: ২০০৮ সালে আরপিওতে আনা সংশোধনী স্মরণ করে, তারা প্রতিটি দলকে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তের পক্ষেই আছে, তবে গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়েছে।
বিএনপি নির্বাচনী কমিশন ও আইন উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে এবং এই বিধান পরিবর্তনের জন্য পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচন তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনা একটি সংবেদনশীল প্রক্রিয়া।
এর আগে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনকে অযৌক্তিক মনে করে মানতে চায় না, অন্যদিকে জামায়াত নভেম্বরেই গণভোট চায়। এনসিপি দুই দলের মধ্যে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছে।
সংশোধিত আরপিওর প্রভাব
এই সংশোধনীর প্রভাব পড়বে নির্বাচনী রাজনীতির বিভিন্ন স্তরে:
- জোটভুক্ত দলগুলোর নির্বাচনী কৌশল পরিবর্তন হবে।
- প্রতীকের বিষয়টি ভোটারদের কাছে আরও স্পষ্ট হবে।
- আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে দায়িত্ব প্রদান সহজ হবে।
- প্রার্থীর সম্পদ ও যোগ্যতা সম্পর্কে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী, এটি রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ মতামত
রাজনীতিবিদ এবং নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, “আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদে সংশোধনী স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য আনা হয়েছে। তবে জোটভুক্ত দলের স্বার্থ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে।”
এক বিশেষ আইন উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, “যেখানে প্রতিটি দল নিজস্ব প্রতীকে অংশগ্রহণ করবে, সেখানে ভোটার বিভ্রান্তি কমবে। তবে রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজন এখনও অগ্রাধিকার থাকা উচিত।”
আরপিও বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি। সম্প্রতি আনা সংশোধনী বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তাদের স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই ইস্যু রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
এম আর এম – ২০৫৫,Signalbd.com



