লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের দেওপাড়া গ্রামে ঘটেছে এক হৃদয়বিদারক ও হতবাক করা ঘটনা। খালাতো বোনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের খালাতো ভাইয়ের সিএনজি অটোরিকশায় আগুন দিয়েছে এক যুবক। এতে রাতের নীরবতা ভেঙে মুহূর্তেই জ্বলে ওঠে এক পরিবারের জীবিকার একমাত্র ভরসা—সিএনজি যানটি।
ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার দিবাগত রাতে (১ নভেম্বর, ২০২৫) সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের দেওপাড়া গ্রামের করিম বক্স ব্যাপারী বাড়িতে। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, অভিযুক্ত যুবক সুজন দীর্ঘদিন ধরে নিজের খালাতো বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। কিন্তু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর থেকেই সে ক্ষোভ পুষে রেখেছিল।
ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা
রবিবার (২ নভেম্বর) দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত সিএনজির মালিক মনির হোসেন সংবাদমাধ্যমের কাছে ঘটনার বিবরণ দেন। তিনি জানান, তার খালাতো ভাই সুজন নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজার এলাকার সুতার বাড়ির দুলালের ছেলে।
মনির বলেন,
“সুজন অনেক দিন ধরেই আমার বোনকে উত্ত্যক্ত করত। প্রথমে আমরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতাম, কিন্তু পরে তার আচরণ সীমা ছাড়িয়ে যায়। এরপর সে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমরা রাজি হইনি। বরং বিষয়টি পুলিশকে জানাই। ১৫ দিন আগে আমার বোনের বিয়ে অন্যত্র হলে সে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।”
মনির আরও জানান, শনিবার গভীর রাতে তার বাড়ির আঙিনায় পার্ক করা সিএনজি অটোরিকশায় হঠাৎ আগুন ধরে যায়। পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে থাকলেও আগুনের গন্ধ টের পেয়ে তারা বেরিয়ে আসেন। দেখা যায়, অটোরিকশাটি আগুনে পুড়ছে এবং দূরে সুজনকে কয়েকজন সহযোগীসহ দৌড়ে পালাতে দেখা যায়।
স্থানীয়দের আতঙ্ক ও প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর পুরো এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। স্থানীয়রা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন, তবে ততক্ষণে পুরো যানটি ভস্মীভূত হয়ে যায়।
দেওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিন বলেন,
“রাত তিনটার দিকে হঠাৎ আগুনের চিৎকার শুনে বের হই। দেখি মনিরের সিএনজি পুড়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে পানি ঢেলে আগুন নিভানোর চেষ্টা করি। আমরা সন্দেহ করি, এটা পরিকল্পিত কাজ।”
আরেক প্রতিবেশী জানান, সুজনের চরিত্র নিয়ে গ্রামে আগে থেকেই নানা অভিযোগ ছিল। সে প্রায়ই এলাকার তরুণীদের উত্ত্যক্ত করত, তবে কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলত না।
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল
চন্দ্রগঞ্জ থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, সুজনের বিরুদ্ধে পূর্বে একাধিক সাধারণ অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে নারীদের হয়রানি সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ থানায় নথিভুক্ত হয়েছে। তবে অনেক সময় পারিবারিক সম্পর্কের কারণে বিষয়গুলো আপসে মিটিয়ে নেওয়া হয়।
এই ঘটনায় মনির হোসেন লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং তদন্ত শুরু হয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য
চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ফয়জুল আজীম জানান,
“সিএনজি অটোরিকশা পোড়ানোর খবর পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠাই। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, এটি একটি পরিকল্পিত আগুন লাগানোর ঘটনা। ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। লিখিত অভিযোগ পেয়েছি, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত সুজন পলাতক রয়েছে। তাকে আটকের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
বিয়েতে রাজি না হলে সহিংস প্রতিশোধ — সমাজে বাড়ছে এ ধরনের ঘটন
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক অবক্ষয় ও নারীর প্রতি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দেশে এমন ঘটনাগুলো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যান বা বিয়েতে রাজি না হওয়ায় প্রতিশোধ নিতে গিয়ে অনেক তরুণ অপ্রাপ্তবয়স্ক বা আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যার পরিণতি ভয়াবহ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন,
“প্রেম বা সম্পর্ক প্রত্যাখ্যানকে অনেকেই ‘অপমান’ হিসেবে নেয়। এর পেছনে পরিবার ও সমাজের মানসিকতারও বড় ভূমিকা রয়েছে। সঠিক নৈতিক শিক্ষা ও আইনি সচেতনতার অভাব থেকেই এসব সহিংসতার জন্ম।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“এ ধরনের অপরাধকে ‘প্রেমের ব্যর্থতা’ বলে হালকাভাবে দেখা ঠিক নয়। এটি একটি সংগঠিত অপরাধ, যা সামাজিক শাস্তির পাশাপাশি আইনগতভাবে কঠোর পদক্ষেপ দাবি করে।”
স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাসনিম জাহান বলেন,
“ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছি। এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাড়তি নজরদারি রাখা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“মনির হোসেনের পরিবারের ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
আইনজীবীর মন্তব্য
লক্ষ্মীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট সেলিম উল্লাহ বলেন,
“বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৩৫ ধারা অনুযায়ী, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কারও সম্পত্তিতে আগুন লাগায়, তার সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা। যদি সেই সম্পত্তি জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে শাস্তি আরও বাড়তে পারে।”
তিনি বলেন,
“এই ঘটনায় স্পষ্টভাবে প্রতিহিংসার উদ্দেশ্য ছিল। পুলিশ সঠিক তদন্ত করলে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনতে কোনো সমস্যা হবে না।”
গ্রামীণ সমাজে ‘সম্মান’ ও ‘প্রেম’ নিয়ে ভুল ধারণা
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এখনো প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানকে অনেক সময় সামাজিক লজ্জা হিসেবে দেখা হয়। এর ফলেই অনেক তরুণ প্রতিশোধ নিতে গিয়ে এমন ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
মনোবিজ্ঞানী তানিয়া রহমান বলেন,
“যখন কেউ প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়, তখন সে মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন সমাজ তাকে শেখায় যে, ‘প্রত্যাখ্যান মানে অপমান’। সেই অপমান ঘোচাতে গিয়ে অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।”
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতি রোধে পরিবারে নৈতিক শিক্ষা, ছেলে-মেয়েদের প্রতি সম্মানবোধ এবং সম্পর্ক ভাঙলে কীভাবে তা গ্রহণ করতে হয়—এসব শেখানো জরুরি।
মনিরের পরিবারের অসহায় অবস্থা
মনির হোসেন জানান,
“এই সিএনজিটাই ছিল আমাদের জীবিকার একমাত্র উপায়। প্রতিদিন ভাড়া চালিয়ে সংসার চলত। এখন সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। নতুন গাড়ি কেনার মতো সামর্থ্য নেই।”
তার স্ত্রী কণ্ঠ ভার করে বলেন,
“আমাদের কিছুই রইল না। শুধু ভয়ের মধ্যে আছি, যদি আবার কিছু করে বসে।”
গ্রামে এখন আতঙ্কের পরিবেশ
ঘটনার পর থেকে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে রাতে বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল হালিম বলেন,
“সুজনকে আমরা আগেও বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু সে শোনেনি। এবার যা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। পুলিশ যেন দ্রুত তাকে ধরে।”
অন্য ঘটনা: প্রত্যাখ্যানে প্রতিশোধের আগুন
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সহিংসতা বা আগুন লাগানোর ঘটনা বেড়েছে।
২০২৪ সালে নরসিংদীতে এক যুবক বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মেয়ের বাড়িতে আগুন দেয়, এতে পাঁচটি ঘর ভস্মীভূত হয়।
২০২৩ সালে কুমিল্লায় এক যুবক তার প্রাক্তন প্রেমিকার বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলে আগুন দেয় প্রতিশোধ হিসেবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অপরাধ একই ধরণের মানসিক বিকৃতির ফল।
সমাজের দায় এড়ানো যায় না
লক্ষ্মীপুরের এই ঘটনাটি কেবল একটি পারিবারিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি আমাদের সমাজের নৈতিক ও মানবিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। প্রেম, সম্পর্ক, প্রত্যাখ্যান—সবই জীবনের অংশ। কিন্তু এসব ঘটনায় সহিংস প্রতিশোধ নেওয়া কখনোই ন্যায়সঙ্গত নয়।
মনির হোসেনের পরিবারের মতো আরও বহু পরিবার প্রতিদিন এমন অপরাধের শিকার হচ্ছে। সমাজ যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন না হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে।
লক্ষ্মীপুরের এই ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানুষ যখন নিজের আবেগের নিয়ন্ত্রণ হারায়, তখন সে শুধু নিজের নয়, অন্যের জীবনও ধ্বংস করে ফেলে। প্রেম কখনো জোর করে পাওয়া যায় না, আর সম্পর্ক মানে কখনো প্রতিশোধ নয়।
এখন প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা, এবং তরুণ প্রজন্মের মানসিক বিকাশে পারিবারিক দিকনির্দেশনা। তবেই হয়তো ভবিষ্যতে এমন অমানবিক ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।
MAH – 13596 I Signalbd.com



