আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের মুখপাত্র মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের ওপর একটি স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সময় দুই দেশের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো ছিল। বিশেষ করে বাণিজ্য, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, টেরোরিজমের বিরুদ্ধে সমন্বয় এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছিল।
খাইবার নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুজাহিদ বলেন, “ইমরান খানের নেতৃত্বে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। সীমান্তে ট্রেড রুট খোলা এবং টিপিটি (টেলরিং ট্রান্সপোর্ট প্রোগ্রাম) কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল যা দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ওই সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক এবং প্রগাঢ় ছিল।”
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত এবং দ্বন্দ্ব
মুজাহিদ আরও বলেন, “পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার এবং সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে। বেসামরিক সরকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করে, কিন্তু সেনাবাহিনী প্রায়শই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে। এতে অনেক সময় নীতি এবং বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যবধান দেখা যায়।”
তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, “আফগানিস্তান কখনও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বা সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সুতরাং, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অভিযোগ আনা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট করা দুঃখজনক। এই ধরনের পদক্ষেপ উভয় দেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায় ও সাধারণ জনগণের জন্য ক্ষতিকর।”
সীমান্ত বন্ধ হওয়ার প্রভাব
মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “ডুরান্ড লাইনের ক্রসিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুই দেশের ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সীমান্ত বন্ধ হওয়ার ফলে কাঁচামাল এবং পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়েছে, যা ব্যবসায়িক খাতে সংকট সৃষ্টি করেছে। রাজনীতির কারণে এই ধরনের সীমান্ত বন্ধ করা উচিত নয়। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম রাজনীতির বাইরে রাখাই উচিত।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সীমান্তপথ খোলার জন্য বহুবার আলোচনা করেছি। আমাদের পক্ষ থেকে কখনও রাজনীতি বিষয়ক চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ প্রায়শই ছোটখাটো ঘটনার অজুহাত খুঁজে নেয়। এর ফলে উভয় দেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জন্য বড় ক্ষতি হয়েছে।”
ইমরান খানের নীতি এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা
ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসারণে কাজ করেছিলেন।
- বাণিজ্য সম্প্রসারণ: ইমরান খানের আমলে আফগানিস্তান-পাকিস্তান বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। সীমান্ত ক্রসিং এবং ট্রেড পলিসি সহজ করার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা নিরবিঘ্নে পণ্য স্থানান্তর করতে পারত।
- সীমান্ত নিরাপত্তা: টিটিপি এবং সীমান্ত রুট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উভয় দেশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং অবৈধ পণ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়।
- সামাজিক ও রাজনৈতিক সংহতি: ইমরান খানের নীতি ছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বাইরে রাখা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যবসা ও নিরাপত্তা জোটিত থাকলে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আফগানিস্তানের অবস্থান
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ স্পষ্ট করেছেন যে, আফগানিস্তান সবসময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য প্রস্তুত। তিনি বলেন, “আমরা সর্বদা সীমান্তপথ খোলা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। আফগানিস্তান কখনোই রাজনীতিকে বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত করতে চায়নি। আমরা চাই, উভয় দেশের জনগণ সুবিধা ভোগ করুক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটুক।”
আন্তর্জাতিক প্রভাব
দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি শুধু সীমান্তের সীমাবদ্ধতা বা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল নয়। এটি পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে সমস্যার সমাধান এবং বাণিজ্য পুনঃস্থাপন করা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- অর্থনৈতিক প্রভাব: সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে ব্যবসায়িক লেনদেন কমে যায়, কর্মসংস্থান হ্রাস পায় এবং পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
- নিরাপত্তা প্রভাব: সন্ত্রাসী ও চোরাচালান কার্যক্রম সীমান্তে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে দুই দেশের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়।
- রাজনৈতিক প্রভাব: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
মাওলানা জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ আশা প্রকাশ করেছেন যে, পাকিস্তান-আফগান সম্পর্ক পুনরায় উন্নত হবে। তিনি বলেন, “যদি উভয় পক্ষ রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে থেকে বাস্তব উপায় খুঁজে বের করে এবং সীমান্ত খোলা রাখে, তবে বাণিজ্য ও সম্পর্ক উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। আমরা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে সবসময় অগ্রাধিকার দেব।”
তিনি আরও বলেন, “আফগানিস্তান সবসময় সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত। আমরা বিশ্বাস করি, শান্তি এবং স্থিতিশীলতা শুধু সীমান্তে নয়, পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনবে।”
ইমরান খানের সময় পাকিস্তান-আফগান সম্পর্কের যে ইতিবাচক দিক ছিল, তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত খোলা রাখা, বাণিজ্যিক কার্যক্রম সহজ করা এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে ব্যবসার বাইরে রাখা দুই দেশের জন্য সমানভাবে লাভজনক।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা এসেছে যে, তারা সবসময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন চায় এবং সীমান্ত খোলা রাখার জন্য প্রস্তুত। উভয় দেশের জনগণ এবং ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এই সহযোগিতা থেকে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা পেতে পারে।
এই প্রবন্ধের মাধ্যমে বোঝা যায়, রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পরও সম্পর্কের মূল ভিত্তি হল ব্যবসা, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। ইমরান খানের সময়ের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে উভয় পক্ষ যদি পুনরায় যৌথ উদ্যোগ নেয়, তবে পাকিস্তান-আফগান সম্পর্ক একটি নতুন দিগন্তের দিকে এগোতে পারে।
MAH – 13591 I Signalbd.com



