বিশ্ব

মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

Advertisement

পেট্রোনাস টাওয়ারে আগুন: আতঙ্কে কুয়ালালামপুর, দমকলের তৎপরতা

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের আকাশছোঁয়া স্থাপনা পেট্রোনাস টাওয়ার–৩ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার সকালে ভবনটির ওপরের তলায় অবস্থিত একটি রেস্তোরাঁ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম। দ্রুত ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ে টাওয়ারের বিভিন্ন তলায়, সৃষ্টি হয় ব্যাপক আতঙ্কের।

অগ্নিকাণ্ডের সময় টাওয়ারের ভেতরে অফিস, রেস্তোরাঁ ও পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল। অনেকেই তখন সকালের নাশতার জন্য ভবনের রেস্তোরাঁয় ছিলেন। হঠাৎ ধোঁয়া দেখতে পেয়ে সবাই দ্রুত নিচে নেমে আসার চেষ্টা করেন।

মালয়েশিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা বার্নামা জানিয়েছে, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। দমকলকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন।

আগুনের সূত্রপাত ও প্রাথমিক তদন্ত

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ভবনের ৫৭তম তলায় অবস্থিত একটি উচ্চমানের রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। রান্নার সময় তেলজাতীয় পদার্থে আগুন ছড়িয়ে পড়লে তা মুহূর্তেই পাশের অংশে পৌঁছে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন ধোঁয়া ভবনের ওপরের অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

কুয়ালালামপুর ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ বিভাগের পরিচালক সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হাসান আস’আরি ওমর জানিয়েছেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ১০টিরও বেশি ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। ৭০ জনেরও বেশি দমকলকর্মী উদ্ধারকাজে অংশ নেন। প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

তিনি আরও বলেন, “ভবনের ৫৭তম তলার প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছে।”

ভবন খালি করা ও উদ্ধার অভিযান

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ভবনের ভেতরে থাকা সবাইকে জরুরি সিঁড়ি দিয়ে বের করে আনা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাওয়ারের অ্যালার্ম বেজে ওঠে এবং নিরাপত্তাকর্মীরা সবাইকে নিচে নামার নির্দেশ দেন।

কুয়ালালামপুর পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে এবং আশেপাশের যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। উদ্ধারকাজে সহায়তা করেন মালয়েশিয়ান সিভিল ডিফেন্স ও স্বেচ্ছাসেবীরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিও

অগ্নিকাণ্ডের মুহূর্তে তোলা ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, পেট্রোনাস টাওয়ার–৩ এর ওপরের দিক থেকে ঘন ধোঁয়ার মেঘ বের হচ্ছে এবং আশেপাশের মানুষজন আতঙ্কে স্থান ত্যাগ করছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমেও এই ঘটনাটি শিরোনাম হয়। মালয়েশিয়ার পর্যটন খাতে অন্যতম আকর্ষণীয় এই ভবনে আগুন লাগায় আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

পেট্রোনাস টাওয়ার–৩: মালয়েশিয়ার প্রতীকী স্থাপনা

পেট্রোনাস টাওয়ার–৩, যেটি ‘মেনারা কারিগালি (Menara Carigali)’ নামেও পরিচিত, কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টারে অবস্থিত বিখ্যাত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার কমপ্লেক্সের অংশ। এটি প্রায় ৬০ তলা বিশিষ্ট এবং এর মালিক মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোনাস

ভবনটিতে রয়েছে করপোরেট অফিস, রেস্তোরাঁ, কনফারেন্স সেন্টার, এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের শাখা। প্রতিদিন এখানে শত শত কর্মী ও পর্যটক আসেন।

১৯৯৮ সালে উদ্বোধনের পর থেকে পেট্রোনাস টাওয়ার মালয়েশিয়ার আধুনিক স্থাপত্যের প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এই টাওয়ারগুলোর নকশা করেছিলেন আর্জেন্টাইন স্থপতি সিজার পেলি

আগুনের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও তদন্ত

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর দমকল বাহিনী ভবনটি সম্পূর্ণভাবে তল্লাশি চালায়, যাতে ভেতরে কেউ আটকা পড়ে আছে কিনা তা নিশ্চিত করা যায়। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, আগুনে ভবনের বৈদ্যুতিক সংযোগ, দেয়াল ও আসবাবপত্রের কিছু অংশ পুড়ে গেছে।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগুনের সঠিক কারণ জানতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে থাকছেন দমকল, পুলিশ, এবং ভবনের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি।

তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভবনের ৫৫ তলার ওপরে কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। নিচের অংশে অফিস কার্যক্রম শিগগিরই চালু করা হতে পারে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা

এক প্রত্যক্ষদর্শী, নাম নূর আজিজা, স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি তখন ৫৬ তলায় কাজ করছিলাম। হঠাৎ ধোঁয়া দেখতে পাই। অ্যালার্ম বাজতেই সবাই দ্রুত নিচে নেমে আসে। আমরা ভয় পেয়েছিলাম, কারণ ধোঁয়া খুব ঘন ছিল।”

আরেকজন কর্মী বলেন, “দমকল বাহিনী খুব দ্রুত চলে আসে। তারা সবাইকে শান্ত থাকতে বলে। তাদের কারণে বড় বিপর্যয় থেকে আমরা বেঁচে গেছি।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ

এই ঘটনার পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে জানান, “পেট্রোনাস টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমি উদ্বিগ্ন। আগুনে কেউ হতাহত না হওয়ায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমরা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।”

সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ও থাইল্যান্ডের মিডিয়াগুলোও এ খবর প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে পর্যটন ও ব্যবসায়িক মহলে এই অগ্নিকাণ্ড নতুন করে ভবনের নিরাপত্তা মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

অতীতের অনুরূপ ঘটনা

এটি পেট্রোনাস টাওয়ার কমপ্লেক্সে প্রথম বড় অগ্নিকাণ্ড নয়। ২০১৩ সালে টাওয়ারের পার্কিং এলাকায় একটি ছোট আগুনের ঘটনা ঘটেছিল, যদিও তখন বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। এছাড়া কুয়ালালামপুরের অন্যান্য উঁচু ভবনেও গত এক দশকে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য

স্থাপত্য ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে রেস্তোরাঁ বা রান্নাঘর সংলগ্ন এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, ধোঁয়া সতর্কীকরণ সেন্সর, এবং জরুরি নির্গমন পথের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।

বিশেষজ্ঞ ড. আহমদ হাকিম বলেন, “পেট্রোনাস টাওয়ারের মতো আন্তর্জাতিক মানের ভবনে এমন ঘটনা পুরো ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার ওপর প্রশ্ন তোলে। তদন্তে যদি অবহেলা পাওয়া যায়, তবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

অর্থনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবনের কিছু অংশ সাময়িকভাবে বন্ধ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে পেট্রোনাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের মূল কার্যক্রমে বড় প্রভাব পড়বে না।

তারা আরও জানায়, ভবনের সব ভাড়াটিয়া ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন করে ফায়ার সেফটি অডিট চালু করা হবে।

পেট্রোনাস টাওয়ার–৩ এ আগুনের এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল, আধুনিক ভবনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যত উন্নতই হোক, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া তা কার্যকর নয়। কুয়ালালামপুরবাসীর জন্য এই অগ্নিকাণ্ড ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, তবে দ্রুত উদ্ধারকাজের কারণে বড় বিপর্যয় এড়ানো গেছে।

বর্তমানে ভবনটি নিরাপদ ঘোষণা করা না পর্যন্ত সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। দমকল বিভাগের তদন্ত শেষ হলে জানা যাবে—এই আগুন ছিল একটি দুর্ঘটনা, নাকি মানবীয় ত্রুটির ফল।

MAH – 13579 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button