বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রভাব আবারও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে। যদিও গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে কোনো মৃত্যু হয়নি, তবুও প্রতিদিনই শত শত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৬৫১ জন নতুন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে এ বছরের মোট হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৫১৩ জনে।
ডেঙ্গুর বর্তমান পরিসংখ্যান
শনিবার (১ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের বিভিন্ন বিভাগে নতুন করে ৬৫১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বিভাগভিত্তিক আক্রান্তের সংখ্যা হলো—
- বরিশাল বিভাগে: ১২৯ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগে: ৯৮ জন
- ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে): ১২০ জন
- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে: ১২০ জন
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে: ১১৭ জন
- খুলনা বিভাগে: ১৩ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগে: ২৯ জন
- রাজশাহী বিভাগে: ২২ জন
- সিলেট বিভাগে: ৩ জন
এদিকে একই সময়ের মধ্যে ৬৫৭ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন।
এ পর্যন্ত চলতি বছরে মোট ৬৭ হাজার ৪৫৯ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন, যা একটি ইতিবাচক দিক হলেও আক্রান্তের হার এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ২৭৮ জনে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ২৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন কোনো মৃত্যু না ঘটলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মৌসুমে এখনো ডেঙ্গুর ঝুঁকি শেষ হয়নি। বিশেষ করে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে বৃষ্টি ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এডিস মশার প্রজনন আবারও বেড়ে যেতে পারে।
ডেঙ্গুর আগের বছরের চিত্র
গত দুই বছরেই বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল।
২০২৪ সালে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন ৫৭৫ জন।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
২০২৩ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতির সবচেয়ে ভয়াবহ বছর হিসেবে রেকর্ড গড়েছিল। ২০২৫ সালের শুরুতে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও জুলাই-আগস্টের পর আবারো ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও পরামর্শ
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু এখন আর কেবল বর্ষাকালীন রোগ নয়। বরং এটি বছরজুড়েই ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, নগরায়ন, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, এবং মানুষের অসচেতনতা—সব মিলিয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মিজানুর রহমান বলেন,
“আমরা এখন ডেঙ্গুর একটি স্থায়ী রূপ দেখতে পাচ্ছি। আগে জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যেত, কিন্তু এখন প্রায় সারা বছরই রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এটি দেশের জন্য বড় স্বাস্থ্যঝুঁকির ইঙ্গিত।”
তিনি আরও বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি সরানো, ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, পুরনো টায়ার বা ছাদের ড্রামে পানি জমতে না দেওয়া এখনই জরুরি।”
ঢাকায় ডেঙ্গুর সবচেয়ে বেশি প্রকোপ
প্রতিবছরের মতো এবারও ঢাকা শহরেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষ করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। ঘনবসতি, অপর্যাপ্ত ময়লা পরিষ্কার, ও নিয়মিত ফগিং না হওয়ার কারণে এ অঞ্চলে এডিস মশা সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান,
“আমরা নিয়মিত ফগিং চালাচ্ছি এবং ঘরোয়া পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিচ্ছি। তবে জনগণের সহযোগিতা ছাড়া একা প্রশাসনের পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।”
ডেঙ্গুর উপসর্গ ও প্রতিরোধ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গগুলো হলো—
- হঠাৎ জ্বর আসা
- তীব্র মাথাব্যথা
- চোখের পেছনে ব্যথা
- শরীর ও জয়েন্টে ব্যথা
- বমি বমি ভাব
- ত্বকে ফুসকুড়ি
রোগের জটিল পর্যায়ে রক্তক্ষরণ, রক্তচাপ হ্রাস, ও অঙ্গ বিকল হওয়ার মতো ঝুঁকি থাকে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়:
- বাড়ি ও আশপাশে পানি জমে থাকতে না দেওয়া।
- মশারির ব্যবহার নিশ্চিত করা।
- প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে ফগিং বা স্প্রে ব্যবহার করা।
- ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
- ফ্রিজ, ফুলের টব, ড্রাম, টায়ার ইত্যাদি সপ্তাহে অন্তত একবার পরিষ্কার করা।
গ্রামীণ অঞ্চলেও ডেঙ্গুর বিস্তার
একসময় ডেঙ্গু কেবল শহুরে সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু এখন এটি গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বরিশাল, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেও প্রতিদিন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন,
“আগে ডেঙ্গু মূলত ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। এখন গ্রামীণ জনপদেও রোগী আসছে। স্থানীয় জনগণ এখনো অনেকটাই অসচেতন। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রচার ও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিশেষ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু ওয়ার্ড এবং পর্যাপ্ত স্যালাইন, প্লাটিলেট ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে।
এছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে বলা হয়েছে।
জনগণের দায়িত্ব ও সচেতনতা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে।
এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে, তাই ঘরের ভেতরের পাত্র, ফুলদানি, ফ্রিজের ট্রে বা পানির বোতলেও মশা জন্ম নিতে পারে।
“নিজের বাড়ি পরিষ্কার রাখা মানে নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখা,”
বললেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নাজমুল ইসলাম।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্কুল-কলেজের ভূমিকা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে ডেঙ্গু সচেতনতা ক্লাস, প্যামফ্লেট বিতরণ, ও পরিচ্ছন্নতা দিবস পালন করা হচ্ছে।
ডেঙ্গুর অর্থনৈতিক প্রভাব
স্বাস্থ্যগত ক্ষতির পাশাপাশি ডেঙ্গু দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে।
রোগীর চিকিৎসা ব্যয়, কর্মক্ষমতা হারানো, ও হাসপাতালের অতিরিক্ত চাপ দেশের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর ডেঙ্গুর কারণে বাংলাদেশে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
ভবিষ্যৎ করণীয়
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।
- নগর পরিকল্পনায় মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ
- জলাবদ্ধতা নিরসনে টেকসই পদক্ষেপ
- এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিই হতে পারে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে।
যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুহার কিছুটা কমেছে, কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
নিজ নিজ বাড়ি, অফিস ও আশপাশ পরিষ্কার রাখাই পারে এই প্রাণঘাতী মশাবাহিত রোগ থেকে আমাদের রক্ষা করতে।
MAH – 13578 I Signalbd.com



