অর্থনীতি

সারাদেশে ডিম ও মুরগি উৎপাদন স্থগিত, পোল্ট্রি খাতের বড় সংকট

Advertisement

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ৭ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য ধর্মঘট শুরু

বাংলাদেশের পোল্ট্রি খাত বর্তমানে চরম সংকটে রয়েছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) বলছে, দেশের পোল্ট্রি শিল্পে করপোরেট সিন্ডিকেটের একচেটিয়া দৌরাত্ম্য ও সরকারের নীরবতার কারণে প্রান্তিক খামারিরা টিকে থাকতে পারছেন না। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর, যে বিপিএ শনিবার থেকে সারাদেশে পর্যায়ক্রমে ডিম ও মুরগি উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

বিপিএ কর্তৃক প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, খাতের প্রতি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিশাল। এই খাতের সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০–৬০ লাখ মানুষ যুক্ত, যার মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ নারী ও ৬০ শতাংশ শিক্ষিত যুবক। তবে, করপোরেট সিন্ডিকেটের একচেটিয়া বাজার দখলের কারণে বৃহত্তম কৃষিভিত্তিক এই খাত ধ্বংসের মুখে।

করপোরেট সিন্ডিকেটের একচেটিয়াভাবে বাজার দখল

বাংলাদেশে পোল্ট্রি খাতের প্রধান সমস্যা হলো ফিড, বাচ্চা মুরগি এবং মেডিসিনসহ ভ্যাকসিনের দাম নিয়ন্ত্রণে করপোরেটদের একচেটিয়া দখল। বিপিএ জানিয়েছে, এই সিন্ডিকেটের কারণে খামারিরা উৎপাদন খরচও পূরণ করতে পারছেন না।

বিপিএ-এর অভিযোগ, সরকারের নীরবতা এবং করপোরেট প্রভাবের কারণে প্রান্তিক খামারিরা ঋণ ও বিনিয়োগ সংকটে পড়েছেন। অনেক খামারি ফিড, ভ্যাকসিন ও ওষুধের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি সামলাতে পারছেন না। এর ফলে খাতের উৎপাদন কমছে, বাজারে ডিম ও মুরগির দাম অনিয়মিতভাবে ওঠানামা করছে, এবং সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত খরচের বোঝা বহন করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পোল্ট্রি খাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু খামারি নয়, দেশের প্রায় সকল ভোক্তাও সরাসরি প্রভাবিত হবে।

বিপিএ-এর ৭ দফা দাবি

বিপিএ আগামীতে স্থায়ী সমাধানের জন্য সাতটি মৌলিক দাবি নিয়েছে। এই দাবিগুলি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত সারাদেশে উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। দাবিগুলি হলো:

১. ফিড, বাচ্চা মুরগি, মেডিসিন ও ভ্যাকসিনের দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারণ
বিপিএ-এর মতে, বাজারে কার্পোরেট সিন্ডিকেটের দখল ভেঙে দিতে হবে। এর মাধ্যমে খামারিরা সঠিক খরচে উৎপাদন করতে পারবে।

২. করপোরেট প্রভাবমুক্ত, ন্যায্য ও স্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা
প্রতিযোগিতা বাড়ানো এবং বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে খামারিদের নিরাপদ উৎপাদন পরিবেশ তৈরি করা হবে।

৩. প্রান্তিক খামারিদের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা
নীতি তৈরি করার সময় খামারিদের অভিজ্ঞতা ও মতামত অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

৪. ফিড, বাচ্চা মুরগি ও ওষুধের বাজারে নিয়মিত অডিট এবং প্রকাশযোগ্য প্রতিবেদন ব্যবস্থা চালু করা
এতে বাজারের স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত হবে।

৫. উৎপাদন খরচ অনুযায়ী ১০ শতাংশ লাভ যুক্ত করে ডিম ও মুরগির ন্যায্য দাম নির্ধারণ
এর ফলে খামারিরা উপযুক্ত মুনাফা পাবেন এবং বাজারে সঠিক দাম স্থির হবে।

৬. ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য জামানতবিহীন ঋণ, প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদান
খামারিরা পুনরায় উৎপাদন শুরু করতে সক্ষম হবেন।

৭. নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও করপোরেটপন্থি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ
সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিলে খাতের কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ থাকবে।

দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। দেশের ভোক্তাদের দৈনিক প্রোটিন চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় ডিম ও মুরগি থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি উৎপাদন বন্ধ থাকে, তাহলে বাজারে ডিম ও মুরগির অভাব দেখা দেবে, দাম বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।

সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্য অধিদপ্তর এবং শিল্পমন্ত্রী ইতিমধ্যে কয়েকটি জরুরি বৈঠক করেছেন। তবে বিপিএ-এর মতে, সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। খামারিরা বলছেন, কার্যকর নীতি না আসা পর্যন্ত তারা উৎপাদন শুরু করতে পারবেন না।

খামারিদের করুণ অবস্থা

দেশের প্রায় সব প্রান্তিক খামারি ছোট এবং স্বল্প সম্পদসম্পন্ন। তারা নিজেদের পরিবার ও সম্প্রদায়ের জীবনধারণের জন্য পোল্ট্রি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে অনেক খামারি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কিছু খামারি ইতিমধ্যেই খামারি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

এছাড়া, খামারিরা জানাচ্ছেন, ফিড, বাচ্চা মুরগি এবং ভ্যাকসিনের দামের অতিরিক্ত ঊর্ধ্বমুখী চাপের ফলে তাদের উৎপাদন প্রায় অক্ষম হয়ে গেছে। তারা সরকারকে দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে আহ্বান জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বব্যাপী পোল্ট্রি খাত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বেশিরভাগ দেশে ছোট খামারিরা বৃহৎ করপোরেট সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে সরকারের নীতিমালা ও প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে খামারিদের রক্ষা করা হয়।

বাংলাদেশও যদি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে পোল্ট্রি খাতের প্রতি বিনিয়োগ কমে যাবে এবং খাদ্য সেক্টর স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিপিএ-এর ৭ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হলে দেশে উৎপাদন বন্ধের প্রভাব শুধু খামারি নয়, সাধারণ ভোক্তাকেও স্পর্শ করবে। সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা, করপোরেট প্রভাবমুক্ত নীতি, এবং প্রান্তিক খামারির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ডিম ও মুরগি খাতের সংকট সমাধান না হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা দুটোই ঝুঁকির মুখে পড়বে। তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়।

MAH – 13576 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button