কেশবপুরে মাছ চাষে নতুন অধ্যায়
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা দেশের অন্যতম প্রধান মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। এ বছর (২০২৪-২৫ অর্থবছর) কেশবপুর আবারও নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে। সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এ উপজেলায় উৎপাদিত মাছের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকা।
স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য কর্মকর্তাদের মতে, কেশবপুরে মিঠা পানির মাছের পাশাপাশি গলদা ও বাগদা চিংড়ির উৎপাদনেও বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। এই উৎপাদন কেবল স্থানীয় চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে—বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে।
ঘের ও পুকুরভিত্তিক মাছ উৎপাদনের পরিসংখ্যান
কেশবপুর মৎস্য অফিসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উপজেলায় মোট ৪ হাজার ৬৫৮টি মৎস্যঘের এবং ৬ হাজার ৬৪০টি পুকুরে মাছ চাষ করা হয়েছে।
এর মধ্যে:
- সাধারণ ঘের: ২,৮৪২টি, আয়তন ৫,৩৯১ হেক্টর
- বাণিজ্যিক ঘের: ৫১৭টি, আয়তন ১,২২৫ হেক্টর
- পুকুর: ৬,৬৪০টি, আয়তন ৬৯৮ হেক্টর
- গলদা চিংড়ির ঘের: ৬৬১টি, আয়তন ৫১৫ হেক্টর
- বাগদা চিংড়ির ঘের: ৬৩৮টি, আয়তন ৩১৫ হেক্টর
এই ঘের ও পুকুরগুলো থেকে রুই, কাতল, পাবদা, শিং, মাগুর, তেলাপিয়াসহ সাদা মাছ উৎপাদন হয়েছে ২৭,৫৭৫ টন। এছাড়া গলদা ও বাগদা চিংড়ির উৎপাদন হয়েছে যথাক্রমে ২,৪০০ টন ও ২৬৫ টন।
উৎপাদিত এই মাছের মোট বাজারমূল্য প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৫০ কোটির বেশি।
গত বছরের তুলনায় বড় সাফল্য
২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেশবপুরে মোট ৪,৬০২টি ঘেরে মাছ চাষ হয়েছিল, যার উৎপাদন ছিল ২৯,১২২ টন। এ বছর সেই উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯০০ টন।
মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭,৭৫ টন, কিন্তু বাস্তবে উৎপাদন হয়েছে তার চেয়ে ৫০০ টন বেশি—যা স্থানীয় চাষিদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সরকারি সহায়তার সাফল্য প্রকাশ করে।
স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি
কেশবপুরের প্রায় ২০ হাজার পরিবারের জীবন-জীবিকা মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় বাজারে প্রতিদিনই বিক্রি হয় কয়েক শ’ মণ মাছ। কেশবপুর সদর, সাগরদাঁড়ি, পাজিয়া, গৌরনগর, চাঁদপুর, ও গৌরনগর বাজার মাছ বিক্রির বড় কেন্দ্র।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন,
“আগে আমরা শুধু স্থানীয় বাজারেই মাছ বিক্রি করতাম। এখন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে মাছ কিনে নিয়ে যায়। ফলে দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে।”
এই বিপুল মাছ উৎপাদনের ফলে কেশবপুরে শুধু কৃষি নয়, বরং পরিবহন, বরফকল, জাল ও ফিড ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
রপ্তানিতে সাফল্যের ধারা
কেশবপুরের উৎপাদিত গলদা, বাগদা চিংড়ি ও পাবদা মাছ ইতোমধ্যে ইউরোপ, জাপান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে। স্থানীয় চাষিরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে “কেশবপুর ব্র্যান্ড” এখন পরিচিত নাম।
মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, রপ্তানিযোগ্য মাছের মান নিশ্চিত করতে নিয়মিত বায়োসিকিউরিটি প্রশিক্ষণ, পানি বিশ্লেষণ ও খাদ্যমান পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া রপ্তানির আগে সরকারি অনুমোদিত ল্যাব থেকে গুণগত মান যাচাই বাধ্যতামূলক।
চাষিদের অভিজ্ঞতা ও দাবি
স্থানীয় দুই চাষি, কাশেম মোড়ল ও লুৎফর রহমান বলেন,
“সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণের ব্যবস্থা থাকলে কেশবপুরে মাছ উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। অনেক সময় খাদ্য, জাল ও ওষুধের দাম বেড়ে যায়, এতে চাষিদের খরচও অনেক বেড়ে যায়।”
তারা আরও জানান, ঘূর্ণিঝড় বা অতিবৃষ্টির সময় ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সরকারি আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হয়।
আরেক চাষি নূর আলম বলেন,
“আমরা যদি আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করতে পারি, যেমন বায়োফ্লক বা আরটিএস পদ্ধতি, তাহলে উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব।”
মৎস্য কর্মকর্তার মন্তব্য
কেশবপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুদীপ বিশ্বাস বলেন,
“এ বছর মোট ৪,৬৫৮টি ঘেরে প্রায় ৩০ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকা। আমাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি সহায়তা ও নজরদারির ফলে চাষিরা আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন,
“আমরা চাষিদের জৈব খাদ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করছি, যাতে মাছের মান উন্নত হয় এবং বিদেশে রপ্তানি আরও সহজ হয়। আগামী বছরে উৎপাদন আরও বাড়াতে বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে।”
সরকারের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে মৎস্য উৎপাদন ৭০ লাখ টন ছাড়িয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণে যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘের ও পুকুরভিত্তিক চাষ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেশবপুরের জলবায়ু ও মাটির গঠন মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পানির লবণাক্ততা মাঝারি হওয়ায় এখানে একই সঙ্গে মিঠা পানির মাছ ও চিংড়ি চাষ সম্ভব — যা দেশের অন্য অনেক এলাকায় সম্ভব নয়।
ভবিষ্যতে কেশবপুরে মৎস্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প, কোল্ড স্টোরেজ ও রপ্তানি কেন্দ্র গড়ে উঠলে এখানকার অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে বলে আশা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের।
শিক্ষা ও গবেষণার দাবি
স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তারা বলছেন,
“মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা ইনস্টিটিউট থাকলে নতুন প্রজন্মও মাছ চাষে আগ্রহী হবে। বর্তমানে আমরা ইউটিউব ও সামাজিক মাধ্যম থেকে শিখে চেষ্টা করছি, কিন্তু সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ পেলে আরও ভালোভাবে কাজ করা সম্ভব।”
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেন বলেন,
“কেশবপুরের মাছ চাষ পদ্ধতিতে ইতিমধ্যে টেকসই উন্নয়নের ধারা শুরু হয়েছে। যদি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি কমানো যায়, তাহলে এখানকার উৎপাদন আগামী পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হতে পারে।”
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
তবে সব সাফল্যের মাঝেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ বন্যা বা খরা উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে।
- ঘেরে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বেড়েছে।
- খাদ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি চাষিদের মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে।
- চিংড়ি রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে এখনও কিছু কারিগরি ঘাটতি রয়েছে।
এসব সমস্যা সমাধানে স্থানীয় প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
মাছ উৎপাদনে এবারও সারা দেশে শীর্ষে কেশবপুর। সরকারি সহায়তা, চাষিদের পরিশ্রম ও প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশে এই অঞ্চলের মাছ চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের আমিষের চাহিদা পূরণ থেকে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন—সব ক্ষেত্রেই কেশবপুর এখন এক উজ্জ্বল নাম।
MAH – 13568 I Signalbd.com



