প্রতীক তালিকায় ‘শাপলা কলি’ যুক্ত হওয়া মূলত এনসিপিকে বাচ্চা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা: সামান্তা শারমিন
নির্বাচনী প্রতীক তালিকায় ‘শাপলা কলি’ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেত্রী সামান্তা শারমিন অভিযোগ করেছেন, এই প্রতীক নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এনসিপিকে “বাচ্চা” বা “অনুজ দল” হিসেবে দেখানোর একটি প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, এটি শুধু প্রতীক নয়, রাজনৈতিক বার্তাও বহন করছে যা একটি দলের মর্যাদাকে খাটো করার ইঙ্গিত দেয়।
ইসির সিদ্ধান্ত ও নতুন প্রতীকের ঘোষণা
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নতুন প্রতীক তালিকা প্রকাশ করেছে। বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ‘শাপলা কলি’কে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইসির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নির্বাচন বিধিমালা ২০০৮ সংশোধনের মাধ্যমে নতুন প্রতীক সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে নতুন কিছু রাজনৈতিক দলকে প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে প্রতীকের বৈচিত্র্য দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।
তবে, এনসিপির পক্ষ থেকে এই প্রতীককে গ্রহণযোগ্য বলা হয়নি। দলটির নেতারা অভিযোগ করেছেন, শাপলার পরিবর্তে শাপলা কলি দেওয়া মানে তাদের মূল প্রতীকের ভাবমূর্তি ও ঐতিহ্যকে বিকৃত করা।
সামান্তা শারমিনের ক্ষোভ: “এটি এনসিপিকে ছোট দেখানোর কৌশল”
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “পূর্ণাঙ্গ শাপলা না দিয়ে শাপলার কলি দেওয়া মানে আমাদের দলের প্রতীকের মর্যাদা খাটো করা। শাপলার কলি দিলে শাপলাও দেওয়া সম্ভব—তাহলে কলির প্রয়োজন কী?”
তিনি আরও দাবি করেন, “এটি একটি সুস্পষ্ট বার্তা—ইসি চাইছে এনসিপিকে রাজনৈতিকভাবে অপরিণত বা নবীন হিসেবে তুলে ধরতে। এই ধরনের প্রতীক নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার ওপর প্রশ্ন তোলে।”
তার মতে, কমিশনের এমন সিদ্ধান্ত ভোটারদের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ছোট দলের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে।
এনসিপির অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া ও অসন্তোষ
দলটির যুগ্ম সদস্যসচিব জহিরুল ইসলাম মুসা একই সুরে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “আমরা ‘শাপলা কলি’ প্রতীককে মেনে নিচ্ছি না। আমাদের প্রার্থিত প্রতীক ‘শাপলা’, কারণ সেটিই এনসিপির প্রতীক হিসেবে চাওয়া হয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “ইসি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করার কৌশল হতে পারে।”
এনসিপির অন্যান্য নেতারাও বলেছেন, প্রতীক নিয়ে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতি অবিচার করছে। অনেকের মতে, এটি শুধু একটি প্রতীকের প্রশ্ন নয়, বরং দলের রাজনৈতিক পরিচয় ও ভোটারদের মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নও।
কেন ‘শাপলা’ প্রতীক নিয়ে এত বিতর্ক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনী প্রতীক একটি দলের পরিচয়ের অন্যতম প্রধান উপাদান। গ্রামীণ ভোটারদের কাছে প্রতীকের পরিচিতি দলের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
‘শাপলা’ প্রতীকটি বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হিসেবে বহুল পরিচিত এবং এটি রাজনৈতিক প্রতীকের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান দখল করে আছে।
এর আগেও কিছু দল শাপলা প্রতীকের দাবিদার ছিল। এবার এনসিপি শাপলাকে তাদের পছন্দের প্রতীক হিসেবে দাবি করলেও ইসি “শাপলা কলি” যুক্ত করে একটি ভিন্ন প্রতীক প্রদান করেছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, এই ছোট্ট পার্থক্যই আসলে বড় বার্তা বহন করছে—এটি প্রতীকীভাবে দলকে “অপরিণত” বা “নবীন” দেখানোর ইঙ্গিত হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত: প্রতীকের পেছনে রাজনৈতিক বার্তা
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুল হক মনে করেন, “নির্বাচনী প্রতীক কেবল একটি চিহ্ন নয়, এটি ভোটারের মানসিকতার সঙ্গে যুক্ত। ‘শাপলা কলি’ ও ‘শাপলা’র মধ্যে পার্থক্য সাধারণ ভোটার বুঝবে না, কিন্তু প্রতীকটি রাজনৈতিকভাবে একটি ভিন্ন ইঙ্গিত দিতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি ইসি সত্যিই নিরপেক্ষ হয়, তাহলে প্রতীক নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দলের মতামত গ্রহণ করা উচিত ছিল। এখন এই ঘটনার মাধ্যমে ইসির ওপর অবিশ্বাস আরও বাড়বে।”
নির্বাচনী কমিশনের অবস্থান
ইসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “নির্বাচনী প্রতীক তালিকা তৈরি হয় একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। কোনো দলকে হেয় করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং প্রতীকের ভিন্নতা নিশ্চিত করার জন্যই নতুন প্রতীক যুক্ত করা হয়েছে।”
তবে, ইসি আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিতর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তাদের দাবি, প্রতীক নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ আইনি ও নীতিমালাভিত্তিক।
সম্ভাব্য প্রভাব ও পরবর্তী করণীয়
এই সিদ্ধান্তের পর এনসিপি অভ্যন্তরীণভাবে বৈঠক ডেকেছে বলে জানা গেছে। তারা নির্বাচন কমিশনের কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারে। দলীয় নেতারা মনে করছেন, “শাপলা কলি” প্রতীক মেনে নিলে তাদের ভোটার বেসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিতর্ক যদি সমাধান না হয়, তাহলে ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতীক বরাদ্দে ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠতে পারে।
‘শাপলা কলি’ প্রতীক ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক এখন জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। সামান্তা শারমিনের মন্তব্য ইঙ্গিত দেয়, এনসিপি বিষয়টিকে রাজনৈতিক মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে দেখছে।
তবে নির্বাচন কমিশন কীভাবে এই সমালোচনার জবাব দেয় এবং এনসিপি পরবর্তী পদক্ষেপে কী সিদ্ধান্ত নেয়—তা-ই এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
এম আর এম – ২০১০,Signalbd.com



