 
						দেশের মোবাইল ফোন খাতে বড় পরিবর্তন আসছে। অবৈধ বা অননুমোদিত পথে দেশে প্রবেশ করা যেকোনো মোবাইল হ্যান্ডসেট আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে আর দেশের কোনো মোবাইল নেটওয়ার্কে কাজ করবে না। কারণ, ওই দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হচ্ছে ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (NEIR) সিস্টেম।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই সিস্টেমের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর (IMEI) জাতীয় ডেটাবেইজে অন্তর্ভুক্ত করবে। ফলে কোনো ফোন অবৈধ হলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
কী এই এনইআইআর (NEIR)?
‘ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার’ সংক্ষেপে এনইআইআর হলো এমন একটি প্রযুক্তি-ভিত্তিক ডেটাবেইজ, যেখানে দেশের প্রতিটি মোবাইল হ্যান্ডসেটের পরিচয় (IMEI নম্বর) সংরক্ষিত থাকবে।
এই সিস্টেমের মাধ্যমে:
- অবৈধ বা চোরাই পথে আনা মোবাইল ফোন বন্ধ করা যাবে,
- সরকারের রাজস্ব ক্ষতি রোধ হবে,
- সাইবার অপরাধ ও প্রতারণা অনেকটাই কমে আসবে।
কেন দরকার এই সিস্টেম?
বিটিআরসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ পথে মোবাইল ফোন আমদানি হচ্ছে। এসব ফোনের কোনো অনুমোদন বা কর পরিশোধ নেই, ফলে সরকার প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, অপরাধমূলক কার্যক্রমেও এসব অনিবন্ধিত ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে। পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা এসব ফোন শনাক্ত করতে পারে না, কারণ ফোনগুলোর কোনো রেকর্ড সরকারি ডেটাবেইজে থাকে না।
এনইআইআর চালুর ফলে এই সমস্যা পুরোপুরি বন্ধ হবে।
কবে থেকে কার্যকর হবে এনইআইআর?
চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে এনইআইআর সিস্টেম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে। এই সময়ের মধ্যে বর্তমানে ব্যবহৃত সব ফোন— বৈধ বা অবৈধ— স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হয়ে যাবে।
তবে ১৬ ডিসেম্বরের পর নতুন যেসব ফোন নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে, তাদের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হবে।
বিদেশ থেকে ফোন আনলে কী হবে?
অনেকেই বিদেশ থেকে মোবাইল আনেন বা উপহার পান। নতুন সিস্টেমে তারাও বাদ যাচ্ছেন না।
বিদেশ থেকে আনা বা উপহার পাওয়া ফোন দেশের নেটওয়ার্কে ৩০ দিন পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে সচল থাকবে। এর মধ্যে গ্রাহককে এনইআইআর ওয়েবসাইটে (neir.btrc.gov.bd) গিয়ে প্রমাণপত্রসহ রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
- পাসপোর্ট ও ভিসা,
- ক্রয় রশিদ,
- কাস্টমস রশিদ ইত্যাদি।
বৈধ প্রমাণপত্র যাচাই শেষে ফোনটি স্থায়ীভাবে নেটওয়ার্কে চালু থাকবে। অন্যথায় এক মাস পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।
বিদ্যমান ফোন ব্যবহারকারীরা কীভাবে জানবেন তাদের ফোন বৈধ কি না?
বর্তমানে ব্যবহৃত সব হ্যান্ডসেট ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হবে। তবুও আপনি নিজে জানতে পারেন আপনার ফোন বৈধ কিনা।
যাচাইয়ের ধাপ:
১️⃣ ফোনের ডায়াল বাটনে *১৬১৬১# লিখে কল দিন।
২️⃣ এরপর ১৫ ডিজিটের IMEI নম্বর টাইপ করুন (ফোনে *#06# লিখলে IMEI দেখা যায়)।
৩️⃣ কিছুক্ষণের মধ্যে আপনি একটি মেসেজ পাবেন, যেখানে জানানো হবে ফোনটি বৈধ নাকি অবৈধ।
এই সেবা পাওয়া যাবে এনইআইআর ওয়েবসাইটেও।
নতুন ফোন কেনার আগে যা জানা জরুরি
এখন থেকে নতুন ফোন কেনার সময় অবশ্যই বৈধতা যাচাই করতে হবে।
যাচাইয়ের নিয়ম:
- মেসেজে লিখুন KYD [স্পেস] ১৫ ডিজিটের IMEI নম্বর
- পাঠিয়ে দিন ১৬০০২ নম্বরে।
 ফিরতি মেসেজে জানিয়ে দেওয়া হবে ফোনটি বৈধ কিনা।
বৈধ ফোন হলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনইআইআর ডেটাবেইজে নিবন্ধিত হবে।
ফোন বিক্রি বা হস্তান্তরের আগে ডি-রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক
১৬ ডিসেম্বর থেকে কোনো গ্রাহক যদি নিজের ফোন বিক্রি করতে চান বা অন্যকে দিতে চান, তাহলে আগে সেটি ডি-রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
এটি করা যাবে:
- এনইআইআর পোর্টাল থেকে,
- মোবাইল অপারেটরের অ্যাপ থেকে,
- অথবা *১৬১৬১# নম্বরে কল করে।
ডি-রেজিস্ট্রেশনের সময় গ্রাহকের NID-এর শেষ চার ডিজিট দিতে হবে।
চুরি বা হারানো ফোনের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ
এনইআইআর চালু হলে ফোন চুরি বা হারিয়ে গেলে সহজেই ব্লক করা যাবে।
গ্রাহক neir.btrc.gov.bd ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ অথবা মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোনটি ব্লক করতে পারবেন।
পরে সেটি ফিরে পেলে আনলক করার সুযোগও থাকবে।
মোবাইল আমদানি ও উৎপাদনে নতুন নিয়ম
এনইআইআর কার্যকর হওয়ার পর থেকে যেসব ফোন দেশে উৎপাদন বা আমদানি করা হবে, তাদের আইএমইআই নম্বর বিটিআরসিতে জমা দিতে হবে।
বিটিআরসি জানিয়েছে, বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশের বেশি ফোন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, আর বাকি কিছু ফোন অনুমোদিত ভেন্ডরদের মাধ্যমে আমদানি হয়।
আইএমইআই জমা না দিলে বৈধ ফোনও নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারবে না।
বিক্রেতাদেরও ফোন বিক্রির আগে আইএমইআই যাচাই করতে হবে। নকল বা ক্লোন ফোন বিক্রি করা যাবে না।
সরকারের লক্ষ্য: রাজস্ব বৃদ্ধি ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী বলেন, “এনইআইআর চালু হলে দেশের টেলিকম খাতে স্বচ্ছতা আসবে। অবৈধ ফোন ব্যবহারের কারণে যেভাবে রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছিল, তা বন্ধ হবে। একইসঙ্গে গ্রাহকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।”
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৮ শতাংশ ব্যবহারকারী ফিচার ফোন ব্যবহার করেন। তাই স্মার্টফোন ব্যবহার বাড়াতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে।
সরকারি প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ৭৩ শতাংশ ডিজিটাল প্রতারণা অবৈধ ফোন ও সিম ব্যবহারের মাধ্যমে ঘটে। এনইআইআর চালু হলে এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।”
তিনি আরও বলেন, “এনইআইআর কেবল একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গ্রাহক সুরক্ষার বিষয়।”
মোবাইল শিল্প ও ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (MIOB)-এর সভাপতি জাকারিয়া শহীদ বলেন,
“এই উদ্যোগের ফলে বৈধ আমদানিকারক ও দেশীয় উৎপাদকরা সমান সুযোগ পাবে। আগে যারা অবৈধভাবে ফোন এনে কম দামে বিক্রি করত, তারা এখন বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। এতে বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকবে এবং সরকারের রাজস্বও বাড়বে।”
অন্যদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর্স অব বাংলাদেশ (AMTOB)-এর মহাসচিব লে. কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন,
“এনইআইআর চালু হলে অপারেটরদের কাজ আরও সহজ হবে। আমরা সবাই মিলে জনসাধারণকে সচেতন করব যেন কেউ অবৈধ ফোন ব্যবহার না করে।”
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এনইআইআর চালু হলে স্থানীয় মোবাইল উৎপাদন শিল্প আরও বিকশিত হবে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮টি মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
অবৈধ আমদানি বন্ধ হলে তারা স্বাভাবিকভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, এবং দেশীয় প্রযুক্তি খাত আরও শক্তিশালী হবে।
গ্রাহকদের জন্য বার্তা
বিটিআরসি গ্রাহকদের সতর্ক করে বলেছে,
১৬ ডিসেম্বরের পর অবৈধ বা ক্লোন মোবাইল সেট দেশের কোনো অপারেটরের নেটওয়ার্কে কাজ করবে না। তাই এখনই নিজের ফোনের বৈধতা যাচাই করে নিতে হবে।
যদি ফোনটি অবৈধ হয়, ৩০ দিনের মধ্যে তা রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ থাকবে। পরে সেটি স্থায়ীভাবে নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে এনইআইআর চালুর মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
এই সিস্টেম কেবল অবৈধ ফোন ব্যবহার বন্ধ করবে না, বরং:
- সরকারকে বছরে শত কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে,
- সাইবার অপরাধ ও ডিজিটাল প্রতারণা কমাবে,
- স্থানীয় মোবাইল শিল্পকে শক্তিশালী করবে,
- আর গ্রাহকদের জন্য এনে দেবে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল ফোন ব্যবহারের নিশ্চয়তা।
অতএব, সময় এসেছে সচেতন হওয়ার। বৈধ ফোন ব্যবহার করুন, সুরক্ষিত থাকুন।
MAH – 13546 I Signalbd.com
 
				 
					


