বিশ্ব

গাজ্জায় ইসরাইলের বর্বর হামলায় ২৪ শিশুসহ ৬৩ শহীদ

Advertisement

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আবারও বয়ে গেল রক্তের স্রোত। চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর নির্বিচার বিমান ও স্থল হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৩ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি নাগরিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ২৪ জন শিশু ও ১১ জন নারী। ভয়াবহ এ হামলার ফলে আবারও মানবিক বিপর্যয়ে নিমজ্জিত হয়েছে পুরো গাজা উপত্যকা।

যুদ্ধবিরতির পরও ইসরাইলের আগ্রাসন

গত ১০ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গাজা ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কিন্তু মাত্র আঠারো দিনের মাথায় সেই চুক্তি ভেঙে দেয় ইসরাইল। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) সকালে শুরু হওয়া এই হামলা ছিল গত এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। স্থানীয় সময় দুপুরের দিকে ইসরাইলি যুদ্ধবিমান গাজা শহরের উত্তরাঞ্চল, খান ইউনিস, রাফাহ এবং সাবরা এলাকায় একযোগে বোমা বর্ষণ শুরু করে।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় জানায়, পুরো হামলায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও অনেকের আটকে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে, ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

নেতানিয়াহুর ‘প্রতিশোধের’ নির্দেশ

ইসরাইলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, দক্ষিণ রাফাহ এলাকায় এক সংঘর্ষে একজন ইসরাইলি সেনা আহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষাবাহিনীকে “শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া” দিতে নির্দেশ দেন।
পরে নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরাইলের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গাজায় নির্দিষ্ট সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে কঠোর আঘাত হানা হয়েছে।”

তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব হামলায় নিহতদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক—যাদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাই বেশি।

হামাসের প্রতিক্রিয়া: ‘যুদ্ধবিরতি ভেঙেছে ইসরাইল’

ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস এক বিবৃতিতে ইসরাইলকে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের জন্য দায়ী করে বলেছে, “ইসরাইলের এই নৃশংস হামলা যুদ্ধবিরতির সম্পূর্ণ অবমাননা।”
হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেড জানিয়েছে, তারা ইসরাইলি এক পণবন্দীর মৃতদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে।

তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, “ইসরাইলের যেকোনো নতুন উসকানি বা হামলা নিখোঁজ সৈন্যদের মৃতদেহ উদ্ধার কার্যক্রমকে স্থায়ীভাবে ব্যাহত করতে পারে।”

হামাসের মুখপাত্র ফাওজি বারহুম বলেন, “ইসরাইল শান্তি চায় না, বরং যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়।”

মার্কিন প্রতিক্রিয়া: ‘যুদ্ধবিরতি এখনো বহাল’

হোয়াইট হাউস এ ঘটনায় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, “যদিও গাজায় সংঘর্ষ চলছে, তবে আমরা মনে করি যুদ্ধবিরতি এখনো কার্যকর আছে। ছোটখাটো সংঘর্ষ এমন পরিস্থিতিতে ঘটে থাকে।”

তিনি আরো যোগ করেন, “আমরা আশা করছি ইসরাইল অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তিচেষ্টা ব্যাহত হবে না।”

তবে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের অবস্থান আসলে ইসরাইলকেই সাহস জোগাচ্ছে ফিলিস্তিনে নতুন হামলা চালানোর জন্য।

মানবিক বিপর্যয়: খাদ্য, ওষুধ ও বিদ্যুৎ সংকট

গাজা উপত্যকা ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম অবরুদ্ধ অঞ্চল। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে মানবিক সরবরাহ কঠোরভাবে সীমিত।
গাজা সরকারের মিডিয়া অফিসের তথ্যমতে, চলমান যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকেও ইসরাইল অন্তত ৯৪ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে এবং খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহ প্রায় বন্ধ রেখেছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দপ্তর (UNHRC) জানিয়েছে, গাজায় এখন প্রতি তিনজনের একজন তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। অধিকাংশ হাসপাতাল বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় চলছে, জরুরি বিভাগে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই, এবং আহতদের চিকিৎসা দিতে পারছে না।

আন্তর্জাতিক নিন্দা ও প্রতিবাদ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ইসরাইলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এবং দক্ষিণ আফ্রিকা যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, “ইসরাইলের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।”
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “নিরীহ শিশুদের ওপর হামলা কোনোভাবেই ন্যায্য হতে পারে না। গাজায় অবিলম্বে মানবিক করিডর খুলে দিতে হবে।”

এদিকে, যুক্তরাজ্যের সংসদে এই ইস্যুতে তীব্র বিতর্ক হয়। বিরোধী দল লেবার পার্টির কয়েকজন এমপি ইসরাইলের ওপর অস্ত্র রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছেন।

গাজার মানুষ: মৃত্যুভয়ে দিনযাপন

গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা লায়লা আবু সালাম (৩২) বলেন, “আমার দুই সন্তান রাতভর কাঁদছে। প্রতিবার আকাশে বোমার শব্দ শুনে ওরা আমার কোলে লুকায়। আমরা জানি না, পরের মুহূর্তে আমাদের বাড়ি থাকবে কিনা।”

আরেক বাসিন্দা, শিক্ষক ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “গাজা এখন এক বিশাল কবরস্থান। এখানে শান্তি বা নিরাপত্তা বলে কিছু নেই।”

স্থানীয় সাংবাদিকরাও জানিয়েছেন, অনেক পরিবার নিজেদের ঘর ছেড়ে জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিচ্ছে। তবে সেখানেও খাবার ও পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে।

ইসরাইলের যুক্তি ও সমালোচনা

ইসরাইল দাবি করছে, তাদের টার্গেট শুধুমাত্র “সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি”। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ইসরাইলের হামলায় নিহতদের অধিকাংশই বেসামরিক।

HRW এক প্রতিবেদনে জানায়, “গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভারী বোমা ব্যবহার করা যুদ্ধাপরাধের শামিল।”

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অবশ্য বলেছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত গাজার মাটি থেকে ইসরাইলের দিকে একটি রকেটও নিক্ষেপ হবে, ততক্ষণ আমাদের প্রতিক্রিয়া চলবে।”

বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ

লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, ইস্তানবুল ও জাকার্তাসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ “Free Palestine” ব্যানার নিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
মানবাধিকারকর্মীরা জানিয়েছেন, “বিশ্ব এখন দেখতে পাচ্ছে, ইসরাইল শুধু গাজায় নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসনের রাজনীতি চালাচ্ছে।”

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও সামাজিক মাধ্যমে #StopKillingChildren, #PrayForGaza, এবং #FreePalestine হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে।

গাজার ভবিষ্যৎ: অনিশ্চয়তার চক্রে এক জাতি

বিশেষজ্ঞদের মতে, চলমান এই হামলা প্রমাণ করছে যে গাজায় শান্তি এখনো অনেক দূরের স্বপ্ন।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক ড. মাহমুদ সালাহ বলেন, “যুদ্ধবিরতি কেবল নামেই আছে। বাস্তবে ইসরাইল প্রতিদিন ফিলিস্তিনের ভেতরে নতুন করে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শান্তির আলো দেখা খুবই কঠিন।”

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি অবরোধ না তুলে নেওয়া হয়, তবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে গাজার অর্ধেকের বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে

গাজা আজ আবারও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শিশুদের কান্না, মায়ের আহাজারি আর বাবার লাশ বহন—এটাই আজকের বাস্তবতা। যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ইসরাইলের এই বর্বরতা আন্তর্জাতিক মানবতাকে আবারও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
বিশ্ব সম্প্রদায় যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে ইতিহাস গাজাকে শুধু এক শহর হিসেবে নয়—একটি নিরবচ্ছিন্ন মানবিক ট্র্যাজেডি হিসেবে মনে রাখবে।

MAH – 13537 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button