দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল আজ অস্বাভাবিকভাবে উত্তপ্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরকে ঘিরে দেশটিতে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপক বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক উত্তেজনা। শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে ট্রাম্পবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে, ব্যানার হাতে প্রতিবাদ জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে।
ট্রাম্পের গাড়িবহর সিউলের মার্কিন দূতাবাসের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় বিক্ষোভকারীরা “নো ট্রাম্প” ও “ইউএস আউট অব কোরিয়া” স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। তারা প্রেসিডেন্টের কনভয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ দ্রুত তাদের প্রতিহত করে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তির ঘটনাও ঘটে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও সিএনএন।
কড়া নিরাপত্তায় সিউল শহর
ট্রাম্পের সফর ঘিরে সিউল এখন প্রায় অর্ধসামরিক ঘাঁটির মতো। পুরো শহরজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে হাজার হাজার পুলিশ সদস্য। বিবিসি জানায়, বিক্ষোভকারীর সংখ্যার তুলনায় রাস্তায় পুলিশের সংখ্যা অন্তত তিনগুণ বেশি। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা (এপেক) সম্মেলনকে সামনে রেখে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে।
একজন দক্ষিণ কোরীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফরের সময় একটি সামান্য ঘটনাও বড় রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে।”
সিউলের প্রধান প্রধান সড়কে যান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। স্কুল ও অফিস এলাকায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা টহল। নাগরিকদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে কেন্দ্রীয় এলাকা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে প্রশাসন।
‘নো ট্রাম্প’ স্লোগানে মুখর সিউল
গিয়ংজু জাদুঘরের বাইরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ ছিল সবচেয়ে বড় ও সংগঠিত। সেখানে ট্রাম্পবিরোধী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা একত্র হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নীতি ও বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। তারা ব্যানার হাতে লিখে আনেন — “Peace, Not War”, “Trump Go Home”, “No More Sanctions”।
বিক্ষোভকারীদের একজন, কিম হি-সান নামের এক তরুণ কর্মী বলেন,
“আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি চাই না। ট্রাম্পের নীতি কেবল উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। এই অঞ্চলে শান্তি নয়, বরং বিভাজন আনছে।”
এদিকে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সড়ক অবরোধ করতে না দেয়ার জন্য শক্ত অবস্থান নেয়। ট্রাম্পের গাড়িবহর গিয়ংজু জাদুঘর ত্যাগ করার কয়েক মিনিট পর বিক্ষোভকারীরা জাদুঘরের গেটের দিকে ছুটে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা: নতুন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু
ট্রাম্পের সফরের আগ মুহূর্তে উত্তর কোরিয়া একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়, যা নতুন করে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পিয়ংইয়ংয়ের এই পদক্ষেপ ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি একটি সরাসরি বার্তা— যুক্তরাষ্ট্র যেন কোরীয় উপদ্বীপে তার সামরিক নীতি পুনর্বিবেচনা করে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রটি জাপান সাগরে পড়েছে। যদিও এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করেছে।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ: মার্কিন নীতি অর্থনীতিতে ধ্বংস আনছে
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা শুল্ক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এশিয়া অঞ্চলের শিল্প ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
একজন বিক্ষোভকারী বলেন,
“এই শুল্কনীতি সাধারণ মানুষের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। কোরিয়ান পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে, অনেক কারখানায় ছাঁটাই চলছে। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি আমাদের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, ট্রাম্পের প্রশাসনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক নানা বাধার মুখে পড়ে। যদিও দুই দেশ সামরিকভাবে ঘনিষ্ঠ মিত্র, অর্থনৈতিক নীতিতে তাদের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন।
এশিয়া সফরে ট্রাম্প: কৌশলগত বার্তা
ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমানে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সফরে রয়েছেন। এর অংশ হিসেবে তিনি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া সফর করছেন। ট্রাম্পের এই সফরকে বিশ্লেষকরা চীনের প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন।
সিউলে ট্রাম্পের সফরের মূল লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে যৌথ অবস্থান নির্ধারণ, এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা। তবে সফর শুরুর আগেই বিক্ষোভের ঝড় সেই বার্তা কিছুটা আড়াল করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র–দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কের টানাপোড়েন
দক্ষিণ কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। কোরীয় যুদ্ধের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ২৮ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে, যারা মূলত উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে সেখানে মোতায়েন।
তবে অনেক দক্ষিণ কোরীয় নাগরিক মনে করেন, এই উপস্থিতি দেশটির স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থানকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভূখণ্ডকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে, যা অঞ্চলের উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন,
“ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অনেকটাই আগ্রাসী। তিনি সহযোগিতার পরিবর্তে প্রভাব বিস্তারে বেশি মনোযোগী। এ কারণেই কোরিয়ায় বিক্ষোভ বাড়ছে।”
গিয়ংবোকগাং প্রাসাদের গেটে নতুন বিক্ষোভ
ট্রাম্পের অবস্থানস্থল থেকে কয়েকশ মিটার দূরে, ঐতিহাসিক গিয়ংবোকগাং প্রাসাদের গেটের সামনেও আরেকটি বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ছাত্র সংগঠন ও শান্তিকামী গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি ও অস্ত্র বিক্রির নিন্দা জানায়।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পার্ক জি-উ বলেন,
“আমরা যুদ্ধ চাই না। কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামরিক শক্তি নয়, কূটনৈতিক আলোচনাই হওয়া উচিত।”
বিশ্বরাজনীতি ও ট্রাম্পবিরোধী প্রবণতা
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এশিয়া সফর কেবল কূটনৈতিক ভ্রমণ নয়; এটি এক ধরনের ‘শক্তি প্রদর্শন’। তবে দক্ষিণ কোরিয়াসহ একাধিক দেশে তার বিরুদ্ধে জনগণের বিরূপ মনোভাব বাড়ছে।
এর পেছনে রয়েছে ট্রাম্পের কিছু বিতর্কিত নীতি— যেমন জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলপন্থী অবস্থান এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তীব্র ভাষা ব্যবহার।
গ্লোবাল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়,
“ট্রাম্পের কণ্ঠস্বর অনেক সময় আগুনের মতো। তার একেকটি বক্তব্যই নতুন কূটনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে।”
শান্তির প্রত্যাশায় দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ যুদ্ধ নয়, স্থিতিশীলতা চায়। ট্রাম্পের সফরকে ঘিরে বিক্ষোভ এটাই প্রমাণ করে যে, মানুষ এখন কূটনৈতিক সংলাপ ও পারস্পরিক সম্মানের রাজনীতি দেখতে চায়।
একজন প্রবীণ নাগরিকের বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট—
“আমরা ১৯৫০ সালের যুদ্ধ দেখেছি। আমরা আর কোনো যুদ্ধ চাই না। বড় শক্তিগুলোর ক্ষমতার লড়াইয়ে আমাদের সন্তানদের রক্ত ঝরুক, তা মেনে নেওয়া যায় না।”
সিউলের রাস্তায় এখনো পোস্টার উড়ছে, স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিবাদের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক আশাবাদ— হয়তো কোনো একদিন দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
সারসংক্ষেপ:
- ট্রাম্পের দক্ষিণ কোরিয়া সফরকে ঘিরে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
- সিউলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে, পুলিশের সংখ্যা বিক্ষোভকারীর তুলনায় তিনগুণ।
- উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নতুন করে উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
- বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা করেছে।
- ট্রাম্পের এশিয়া সফর যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর কৌশলের অংশ।
- দক্ষিণ কোরিয়ায় জনগণের দাবি— শান্তি ও কূটনৈতিক সমাধান।
MAH – 13536 I Signalbd.com



