বিশ্ববিখ্যাত নাইজেরীয় সাহিত্যিক ও নাট্যকার ওলে সোয়িংকা—যিনি ১৯৮৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে প্রথম আফ্রিকান হিসেবে ইতিহাস গড়েছিলেন—তার মার্কিন ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন।
এই তথ্যটি তিনি নিজেই জানিয়েছেন নাইজেরিয়ার লাগোস শহরে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্যিক সভায়। গতকাল মঙ্গলবার কোঙ্গি এলাকার হারভেস্ট গ্যালারিতে বক্তব্য দিতে গিয়ে সোয়িংকা বলেন, সম্প্রতি মার্কিন কনস্যুলেট থেকে তিনি একটি চিঠি পেয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে, তার ভিসা “বাতিলের জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে হবে”।
চিঠি নয়, যেন এক অদ্ভুত প্রেমপত্র
৭০ দশকের এক সময়ের রাজনৈতিক বন্দি থেকে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক—ওলে সোয়িংকা সবসময়ই ছিলেন সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ।
এই ঘটনার সময়ও তিনি নিজস্ব ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন,
“আমি মার্কিন কনস্যুলেট থেকে যে চিঠি পেয়েছি, সেটা একরকম অদ্ভুত প্রেমপত্রের মতো লাগছে।”
চিঠিতে লেখা ছিল,
“আমরা অনুরোধ করছি আপনি মার্কিন কনস্যুলেট, লাগোসে আপনার ভিসা নিয়ে আসুন। ভিসা বাতিলের প্রক্রিয়ার জন্য আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নির্ধারণ করতে ইমেল পাঠাবেন।”
এ সময় উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। সোয়িংকা রসিকতা করে বলেন,
“আমার হয়ে কেউ কি স্বেচ্ছাসেবক হতে চান? আমি এখন বেশ ব্যস্ত, সময় নেই এই কাজটা করার।”
ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও কঠোরভাবে অভিবাসননীতি বাস্তবায়ন শুরু করেন।
তার প্রশাসন জানায়, যারা মার্কিন মূল্যবোধ বা নীতির সঙ্গে “বিরোধপূর্ণ অবস্থান” নেয়, তাদের ভিসা বা গ্রিন কার্ড বাতিল করা হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, সোয়িংকার মতো একজন আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত সাহিত্যিকের ভিসা বাতিল করা সেই নীতিরই অংশ।
ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম দেশগুলোর নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, সীমান্তে অভিবাসীদের আটক, ও ভিসা প্রক্রিয়ায় জটিলতা—সবই বহু আলোচিত বিষয়।
ওলে সোয়িংকার প্রতিক্রিয়া: শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ
সোয়িংকা জানিয়েছেন, ভিসা বাতিলের ঘটনায় তিনি মোটেও হতাশ নন।
তার ভাষায়,
“আমি কনস্যুলেট ও সেখানে কর্মরত মার্কিন নাগরিকদের জানাতে চাই, আমি একদমই অসন্তুষ্ট নই। বরং এটা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।”
তবে তিনি এটিও বলেন, এই সিদ্ধান্ত তার জন্য কিছু সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক সীমাবদ্ধতা তৈরি করবে, কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই সাহিত্য সম্মেলন, বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক ইভেন্টে অংশ নিতেন।
কে এই ওলে সোয়িংকা?
ওলে সোয়িংকার জন্ম ১৯৩৪ সালের ১৩ জুলাই, নাইজেরিয়ার আবেকুতা শহরে। তিনি শুধু একজন সাহিত্যিকই নন, বরং একজন সামাজিক কর্মী, রাজনৈতিক সমালোচক ও মানবাধিকারের যোদ্ধা।
তার রচনায় আফ্রিকার উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজ, ধর্মীয় বিভাজন, স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মানবতার প্রশ্ন গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
তার বিখ্যাত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- Death and the King’s Horseman
- A Dance of the Forests
- The Man Died (একটি আত্মজীবনীমূলক রাজনৈতিক লেখা)
১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালে তিনি শান্তির আহ্বান জানিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছিলেন, যার ফলে তাকে বন্দি করা হয় প্রায় ২৭ মাস।
জেলেই তিনি লিখেছিলেন—
“যখন ক্ষমতার বিরুদ্ধে সত্য বলা অপরাধ হয়ে যায়, তখন নীরবতাই সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।”
সোয়িংকা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক
ওলে সোয়িংকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহু পুরনো। তিনি হার্ভার্ড, ইয়েল এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাহিত্যপ্রেমী সমাজে তার জনপ্রিয়তা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান।
কিন্তু ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের পর থেকে অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি বেড়ে যাওয়ায় অনেক লেখক, শিল্পী ও মানবাধিকারকর্মীর প্রবেশ জটিল হয়ে পড়েছে।
সোয়িংকার ভিসা বাতিল সেই প্রক্রিয়ারই অংশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া
ওলে সোয়িংকার ভিসা বাতিলের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সাহিত্য মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, ও আলজাজিরা এ ঘটনাকে “মার্কিন প্রশাসনের এক সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতার নিদর্শন” বলে মন্তব্য করেছে।
নাইজেরিয়ার লেখক সংঘ (ANA) এক বিবৃতিতে বলেছে,
“ওলে সোয়িংকা শুধু নাইজেরিয়ার নয়, গোটা আফ্রিকার গর্ব। তার মতো একজন মুক্তচিন্তার মানুষকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে অবরুদ্ধ করা মানবতার পরাজয়।”
অন্যদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলেছে,
“ভিসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসমূহ গোপনীয়, এবং প্রতিটি আবেদনকারীর ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বিবেচিত হয়।”
সাহিত্য ও রাজনীতির সংঘাত
ওলে সোয়িংকার ঘটনাটি আবারও সামনে নিয়ে এসেছে সাহিত্য ও রাজনীতির পুরনো দ্বন্দ্ব।
বিশ্বজুড়ে বহু লেখকই রাজনৈতিক মতভেদ বা অবস্থানের কারণে বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছেন বা প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
ইতিহাসে দেখা যায়—
- সোভিয়েত লেখক আলেক্সান্দর সলঝেনিৎসিন নির্বাসনে ছিলেন বহু বছর।
- বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিনকেও একাধিক দেশে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছিল।
- চীনের লিউ শিয়াওবো, আরেক নোবেলজয়ী, রাজনৈতিক মতের কারণে কারাগারে মারা যান।
সুতরাং, সোয়িংকার ভিসা বাতিল শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়—এটি সাহিত্যিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের সীমারেখা নিয়েও নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
ওলে সোয়িংকার বক্তব্যে সতর্ক আশাবাদ
নিজ দেশের তরুণদের উদ্দেশে সোয়িংকা বলেন,
“মুক্তচিন্তা কখনোই পাসপোর্ট বা ভিসার ওপর নির্ভর করে না। সত্য বলার অধিকার আমাদের জন্মগত।”
তিনি আরও বলেন,
“যে দেশগুলো নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষক বলে দাবি করে, তাদের এই ধরনের পদক্ষেপই প্রমাণ করে, স্বাধীনতার ধারণা এখনো অসম্পূর্ণ।”
তার বক্তব্যে হতাশার চেয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ই বেশি ছিল।
ভবিষ্যতে কী হতে পারে
ওলে সোয়িংকা ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অন্য কোনো উদ্যোগ নেবেন না।
বরং তিনি আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে বেশি মনোযোগ দিতে চান।
নাইজেরিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, তারা বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিকভাবে আলোচনার চিন্তা করছে।
ওলে সোয়িংকার ভিসা বাতিল শুধু একজন নোবেলজয়ী লেখকের জন্য নয়, বরং পুরো সাহিত্যজগতের জন্য একটি প্রশ্নচিহ্ন—
সৃষ্টিশীলতার কি কোনো সীমান্ত থাকা উচিত?
যে মানুষ নিজের কলম দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাকে যদি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে থামানো হয়, তবে তা মানবতার জন্যই এক ধরণের সতর্ক সংকেত।
তবুও, সোয়িংকার মতো ব্যক্তিত্বরা দেখিয়ে দেন—
“মুক্ত চিন্তাকে বন্দি করা যায় না, কারণ সেটি থাকে মানুষের বিবেকের গভীরে।”
MAH – 13534 I Signalbd.com



