বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ কৃষি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে এক সাবেক ছাত্রী। অভিযোগ উঠেছে, তিনি তাঁর নারী সহপাঠীদের অজান্তে, গোপনে তাঁদের ব্যক্তিগত ও অপ্রস্তুত অবস্থার ছবি তুলতেন এবং সেগুলো পাঠাতেন এক সিনিয়র ভাইয়ের কাছে।
এই ঘটনাকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে তীব্র আলোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন।
ঘটনার সূত্রপাত ও অভিযোগের বিবরণ
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত ছাত্রী বাকৃবি থেকে সম্প্রতি স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। তিনি ইন্টার্নশিপ চলাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে থাকা নারী সহপাঠীদের ছবি গোপনে তুলতেন। অধিকাংশ সময় সহপাঠীরা ঘুমন্ত অবস্থায় বা অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকতেন। এইসব ছবি তিনি নিয়মিত পাঠাতেন তাঁর সিনিয়র এক ভাইয়ের কাছে, যিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।
অভিযোগকারী সহপাঠীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইন্টার্নশিপের সময় ওই ছাত্রীকে বেশ কিছু সন্দেহজনক আচরণ করতে দেখা যায়। সহপাঠীরা প্রথমে বিষয়টি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর ফোন থেকে ছবি প্রেরণের প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁরা নিশ্চিত হন যে, এটি একটি গুরুতর অপরাধমূলক আচরণ।
প্রশাসনের পদক্ষেপ ও তদন্ত প্রক্রিয়া
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা গতকাল মঙ্গলবার ডিনের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁকে লিখিতভাবে অভিযোগ জমা দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি তদন্তে নেয়।
ডিন অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মজিদ গণমাধ্যমকে জানান,
“শিক্ষার্থীরা অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসে। আমরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে দেখি, সেখানে ছবি আদান-প্রদানের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি সত্যিই মেয়েদের ব্যক্তিগত ছবি তুলতেন এবং সেগুলো এক সিনিয়র ভাইয়ের কাছে পাঠাতেন।”
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত ছাত্রীর মোবাইল ফোন বর্তমানে সিলগালা অবস্থায় ডিন অফিসে সংরক্ষিত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, বিষয়টি এখন যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ ও নিরোধ কমিটির কাছে হস্তান্তর করা হবে।
অভিযুক্ত সিনিয়র শিক্ষার্থীর বক্তব্য
ঘটনায় জড়িত সিনিয়র শিক্ষার্থী, যিনি বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত, তিনি বিষয়টি স্বীকার করেছেন আংশিকভাবে।
তিনি বলেন,
“আমি মেয়েটির সঙ্গে দীর্ঘদিন কথা বলেছি। সে যেসব ছবি পাঠিয়েছে, আমি সেগুলো সংরক্ষণ করিনি। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। আমি স্বীকার করছি, আমি ভুল করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমি তা মেনে নেব।”
তবে তাঁর এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট নয় সহপাঠীরা। তাঁরা মনে করেন, এই ঘটনাটি কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার চরম লঙ্ঘন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সহপাঠীদের ক্ষোভ ও বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে প্রতিক্রিয়া
বাকৃবির শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। অনেকে মনে করছেন, এমন ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
একজন শিক্ষার্থী বলেন,
“আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি যে আমাদেরই এক সহপাঠী এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় এমন জায়গা, যেখানে আমরা নিরাপদে থাকতে চাই। এখন মেয়েরা আতঙ্কে আছে, কেউ কারও সঙ্গে ঘরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না।”
আরেকজন বলেন,
“এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি না দিলে ভবিষ্যতে অন্য কেউ সাহস পাবে একই কাজ করতে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির ভূমিকা
বাকৃবি প্রশাসন ইতিমধ্যেই বিষয়টি যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ ও নিরোধ কমিটির কাছে পাঠিয়েছে। কমিটির একজন সদস্য জানান,
“এটি কেবল ব্যক্তিগত ছবি তোলার ঘটনা নয়, এটি মানসিক নির্যাতনের একটি রূপ। আমরা সব প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দেব। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি অনুযায়ী, এমন অপরাধের জন্য শাস্তি হতে পারে সাসপেনশন, সনদ স্থগিত, এমনকি ডিগ্রি বাতিলও।”
আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনাটি বাংলাদেশে প্রচলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধের মধ্যে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন,
“কারও অনুমতি ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত ছবি তোলা এবং তা অন্যের কাছে প্রেরণ করা — এটি ফৌজদারি অপরাধ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে তাঁদের জেল, জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমন একটি প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের জন্য গভীর হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মতিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন,
“আমরা বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। কোনোভাবেই এই ধরনের আচরণ বরদাস্ত করা হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার হিসেবে আমরা চাই, সকল শিক্ষার্থী যেন নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশে শিক্ষা অর্জন করতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“প্রতিটি হলে এখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় সচেতনতামূলক সেশন আয়োজনের পরিকল্পনাও রয়েছে।”
সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনা শুধু ভুক্তভোগীদের নয়, পুরো শিক্ষাঙ্গনের উপর দীর্ঘমেয়াদি মানসিক প্রভাব ফেলে।
একজন শিক্ষামনোবিজ্ঞানী মন্তব্য করেন,
“যে শিক্ষার্থী এই অপরাধ করেছে, তাঁর মধ্যেও হয়তো আত্মবিশ্বাস বা মানসিক বিকারের সমস্যা থাকতে পারে। তবে তা অপরাধকে ন্যায্যতা দেয় না। ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারেন। তাদের পাশে দাঁড়ানোই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
শিক্ষার্থীদের দাবি ও সামাজিক বার্তা
শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়ে বলেছেন,
১. দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হলে নিরাপত্তা ক্যামেরা ও মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করা হোক।
৩. নারী শিক্ষার্থীদের জন্য গোপনীয় অভিযোগ গ্রহণের অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হোক।
৪. যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নিয়মিত সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালানো হোক।
বাকৃবি ছাত্রীর এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত অপরাধ নয়; এটি আমাদের সমাজে প্রযুক্তির অপব্যবহারের ভয়াবহ দিকটিকে আবারও সামনে এনেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু জ্ঞানার্জনের জায়গা নয়, এটি নৈতিকতা ও মানবিকতারও বিদ্যালয়। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বুঝতে হবে, অপরের ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার প্রবেশ শুধু আইনবিরোধী নয়, এটি এক গভীর সামাজিক অপরাধও।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে যদি এই ঘটনার সঠিক বিচার হয়, তবে সেটি হবে ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা — ‘গোপনে নয়, সম্মানের সঙ্গে বাঁচি।’
MAH – 13533 I Signalbd.com



