বিশ্ব

যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে গাজায় ইসরাইলের ভয়াবহ হামলা, নিহত ২০ ফিলিস্তিনি

Advertisement

গাজা উপত্যকায় চলমান অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির মাঝেই ফের রক্ত ঝরল। ইসরাইলি বাহিনীর সাম্প্রতিক বিমান ও স্থল হামলায় অন্তত ২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫০ জন। হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রের বরাতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, মঙ্গলবার রাতভর গাজা সিটির উত্তরাংশ ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও আটকে রয়েছেন অনেকে।

যুদ্ধবিরতির মধ্যেই নতুন রক্তপাত

১০ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছিল, সেটিই মঙ্গলবারের (২৮ অক্টোবর) হামলায় কার্যত ভেঙে গেল।
এই চুক্তির অধীনে উভয় পক্ষই সীমিত সময়ের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধে সম্মত হয়েছিল, যাতে মানবিক সহায়তা, আহতদের উদ্ধার ও পণবন্দী বিনিময় কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়।

কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি মানেনি ইসরাইল। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোরে দক্ষিণ রাফা ও খান ইউনিসে ইসরাইলি ড্রোন ও যুদ্ধবিমানের হামলায় মুহূর্তেই ধসে পড়ে কয়েকটি আবাসিক ভবন। এতে নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

ইসরাইলি বাহিনীর নতুন অজুহাত

ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, “দক্ষিণ রাফায় হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলি সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়, এতে একজন সেনা আহত হয়।”
এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু “শক্তিশালী প্রতিশোধমূলক হামলার” নির্দেশ দেন।
তার দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “যে কোনও আক্রমণের জবাব দিতে ইসরাইল প্রস্তুত। আমাদের সৈন্যদের ওপর হামলা মানেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন।”

তবে ইসরাইলের এই অবস্থানকে “নির্লজ্জ অজুহাত” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিনি পক্ষ।

হামাসের পাল্টা বিবৃতি: ‘লাশ হস্তান্তর স্থগিত’

ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সশস্ত্র শাখা ‘আল-কাসাম ব্রিগেড’ ইসরাইলের হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে,
“ইসরাইলি আগ্রাসনের ফলে আমরা নিখোঁজ ইসরাইলি সৈন্যদের লাশ হস্তান্তরের পরিকল্পনা স্থগিত করছি।”
এক বিবৃতিতে তারা সতর্ক করে বলেছে, “ইসরাইলের এই উসকানিমূলক হামলা চলতে থাকলে বাকি ১৩ জন পণবন্দীর লাশ উদ্ধারে বিলম্ব হবে, যা শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।”

মার্কিন প্রতিক্রিয়া: ‘যুদ্ধবিরতি এখনো বহাল’

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সাংবাদিকদের বলেন, “যুদ্ধবিরতি এখনও কার্যকর আছে, যদিও ছোটখাটো সংঘর্ষ ঘটছে।”
তিনি বলেন, “আমরা জানি গাজা থেকে কেউ একজন ইসরাইলি সৈন্যকে আক্রমণ করেছে। ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো চান এই অঞ্চলটি শান্ত থাকুক।”

তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান প্রকৃত অর্থে ইসরাইলের আগ্রাসনের প্রতি নীরব সমর্থন ছাড়া কিছু নয়।

গাজায় মানবিক সংকট আরও গভীর

গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মঙ্গলবারের হামলায় নিহতদের মধ্যে চারজন উত্তর গাজার সাবরা এলাকায় এক আবাসিক ভবনের বাসিন্দা, আর পাঁচজন দক্ষিণ খান ইউনিসে নিহত হয়েছেন। এছাড়াও অনেকে ধ্বংসস্তূপে আটকে আছেন, যাদের উদ্ধারে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি না থাকায় উদ্ধারকাজ ধীরগতিতে চলছে।

ইউএনআরডব্লিউএ (জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা) জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির পরও ইসরাইল মানবিক ত্রাণবাহী ট্রাকগুলোর প্রবেশ সীমিত করে রেখেছে। গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
অনেক হাসপাতাল বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে।

‘শক্তিশালী হামলা চালাও’— নেতানিয়াহুর নির্দেশ

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে গাজায় আরও শক্তিশালী ও নির্ভুল হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন।”
যদিও ওই বিবৃতিতে হামলার সরাসরি কারণ উল্লেখ করা হয়নি। পরে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেন, “রাফায় হামলার দায় সম্পূর্ণভাবে হামাসের।”

যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের দায় কার?

বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে, ইসরাইল গত দুই সপ্তাহে অন্তত তিনবার একতরফা হামলা চালিয়েছে, যা স্পষ্টতই যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন।
গাজা মিডিয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৯৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে ৪০ জনের বেশি।

গাজা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ইসরাইল যুদ্ধবিরতির আড়ালে মানবিক সরবরাহ সীমিত করছে এবং এলাকাজুড়ে নজরদারি ড্রোন উড়াচ্ছে, যা স্থানীয়দের আতঙ্কিত করে তুলেছে।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতা

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লীগ— কারও কাছ থেকেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস কেবল “উদ্বেগ” প্রকাশ করেছেন এবং “উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান” জানিয়েছেন।
কিন্তু মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, “ইসরাইল নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে, আর বিশ্ব নেতৃত্বরা চুপ করে থাকছে।”

গাজার মানুষের আর্তনাদ

গাজার বাসিন্দা আহমেদ আল-রায়ান বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম যুদ্ধবিরতি মানে শান্তি। কিন্তু প্রতিদিন রাতেই বিমান হামলার শব্দে ঘুম ভাঙে।”
আরেক নারী, নাহিদা ইউসুফ বলেন, “আমার তিন সন্তান এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে। কেউ উদ্ধার করতে আসেনি। হাসপাতালে জায়গা নেই, ওষুধ নেই, পানি নেই। আমরা কি মানুষ না?”

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ: যুদ্ধবিরতি নাকি নতুন কৌশল?

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরাইলের এই ধারাবাহিক হামলা আসলে “চাপ প্রয়োগের কৌশল”।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল সাফদি বলেন,
“ইসরাইল যুদ্ধবিরতির সুযোগে হামাসকে দুর্বল করতে চায়। তারা মনে করে, ছোট ছোট হামলায় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কম পাওয়া যায়, অথচ চাপ বজায় রাখা যায়।”

তবে হামাসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, “গাজায় প্রতিটি হামলার জবাব দেওয়া হবে, ইসরাইল যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে আগ্রাসন চালালে আমরা নীরব থাকব না।”

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি এক নজরে

  • নিহতের সংখ্যা: অন্তত ২০ জন (শুধু মঙ্গলবারের হামলায়)
  • আহত: ৫০ জনের বেশি
  • যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর নিহত: অন্তত ৯৪ জন ফিলিস্তিনি
  • ত্রাণ প্রবেশ সীমিত: ৬০% কম
  • হাসপাতালের কার্যক্ষমতা: মাত্র ৪০%
  • পানীয় জলের সংকট: ৮০% জনগণ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার আহ্বান

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উভয়েই জানিয়েছে, ইসরাইলের এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের “চরম লঙ্ঘন”।
তাদের মতে, “যুদ্ধবিরতির সময় কোনও পক্ষের সামরিক অভিযান মানবিক আইনের পরিপন্থী। গাজার জনগণকে টার্গেট করা মানেই বেসামরিক হত্যাযজ্ঞ।”

শান্তির পথে আরও দূর গাজা

গাজা উপত্যকায় শান্তির স্বপ্ন যেন মরীচিকা। প্রতিটি যুদ্ধবিরতির পরই সেখানে রক্তের বন্যা বয়ে যায়।
ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ আজও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে, চিকিৎসা, খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাবে দিশেহারা।
বিশ্বশক্তিগুলোর নীরবতা আর ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসন এই অঞ্চলকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

একজন গাজার শিশুর মুখের আর্তনাদেই আজকের বাস্তবতা স্পষ্ট—
“আমরা শুধু বাঁচতে চাই, কিন্তু আকাশের প্রতিটি শব্দই মৃত্যুর বার্তা নিয়ে আসে।”

MAH – 13530 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button