অর্থনীতি

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী জার্মানি

Advertisement

বাংলাদেশ সফরে জার্মান উপমন্ত্রী ইওহান সাটফ: টেকসই জ্বালানি উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বাড়াতে জার্মানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জার্মানির ফেডারেল অর্থনীতি ও জলবায়ু সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ইওহান সাটফ তার প্রথম বাংলাদেশ সফরে এসে জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে “জ্বালানি রূপান্তর” (Energy Transition) নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে।

ঢাকায় সফরকালে তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশকে টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় রূপান্তরে সহযোগিতা করতে চাই। স্মার্ট গ্রিড, সৌরশক্তি, এবং নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহারের উন্নয়নে জার্মানির অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি ভাগাভাগি করতে আগ্রহী।”

তিনি আরও বলেন, “জ্বালানি খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, সৌর ছাদ প্রকল্প (Solar Rooftop), এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় জার্মানি ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। এখন আমরা সেই সহযোগিতা আরও গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি করতে চাই।”

ঢাকার বাস্তব চিত্রে মুগ্ধতা ও বিস্ময়

সফরের শুরুতেই উপমন্ত্রী ইওহান সাটফ ঢাকার তীব্র যানজটে পড়েন। যমুনা টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাস্যরসের ভঙ্গিতে তিনি বলেন, “অবিশ্বাস্য ট্রাফিক! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—সবকিছুই চলছে!”

তবে এই যানজটের বাইরে তিনি বাংলাদেশের মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য, বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ও উন্নয়নের গতি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নয়নের মূলভিত্তি। আমি রাজনীতিতে এসেছি আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য। বাংলাদেশের প্রতিটি মা-বাবার স্বপ্নও একই—একটি নিরাপদ, উন্নত ভবিষ্যৎ।”

বাংলাদেশ-জার্মানি সম্পর্ক: ৫০ বছরের বন্ধুত্ব ও নতুন যুগের সূচনা

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই জার্মানি অন্যতম বিশ্বস্ত উন্নয়ন অংশীদার। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জার্মানি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার

জার্মানি থেকে বাংলাদেশে রপ্তানির প্রধান খাত হলো যন্ত্রপাতি, শিল্প সরঞ্জাম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি। অপরদিকে বাংলাদেশ জার্মানিতে রপ্তানি করে পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, এবং কৃষিপণ্য।

২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছাড়িয়েছে ৭ বিলিয়ন ইউরো, যা গত দশকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

উপমন্ত্রী ইওহান সাটফ বলেন, “জার্মানি শুধু উন্নয়ন সহযোগী নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একজন কৌশলগত অংশীদার। আমরা চাই এই অংশীদারিত্ব আরও মজবুত হোক।”

‘স্মার্ট গ্রিড’ প্রকল্প: জ্বালানি ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনা

জার্মানি বাংলাদেশের সঙ্গে ‘স্মার্ট গ্রিড’ (Smart Grid) প্রযুক্তি চালুর বিষয়ে আলোচনা করছে। এই প্রযুক্তি বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিক, সাশ্রয়ী ও টেকসই হবে।

স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থার মাধ্যমে সৌর, বায়ু ও বর্জ্য থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সহজেই জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৩ শতাংশেরও কম, যা সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে চায়।

ইওহান সাটফ বলেন, “জার্মানি ইউরোপে নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের জন্যও এই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মূল্যবান হবে। আমরা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ উভয় দিকেই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”

বাংলাদেশের জ্বালানি সংকট ও ভবিষ্যতের পথচলা

00 সংকট মোকাবেলায় কঠিন সময় পার করছে। গ্যাসের ঘাটতি, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বৃদ্ধি, এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের শিল্পোন্নয়ন ও নাগরিক জীবন স্বাভাবিক রাখতে বিকল্প জ্বালানি উৎসের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশের স্থায়ী জ্বালানি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন প্রায় ১৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে, যেখানে উৎপাদন হয় প্রায় ১১,০০০ মেগাওয়াট। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সৌর ও বায়ুশক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

জার্মান সহযোগিতা: প্রযুক্তি, বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণ

বাংলাদেশে জার্মান ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন (GIZ) এবং কেএফডব্লিউ ব্যাংক (KfW) ইতোমধ্যে বিভিন্ন জ্বালানি প্রকল্পে কাজ করছে।

  • সৌর ছাদ (Solar Rooftop) প্রকল্পে তারা বাংলাদেশের শিল্প ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে।
  • বায়োগ্যাস ও বর্জ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পে জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
  • বিদ্যুৎ বিতরণে দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ অপচয় রোধে জার্মান বিশেষজ্ঞরা কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন।

ইওহান সাটফ জানান, “জার্মানি শুধু বিনিয়োগই করবে না, বরং বাংলাদেশের তরুণ প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগও তৈরি করবে। এভাবে আমরা একসাথে একটি ‘গ্রীন বাংলাদেশ’ গড়তে পারি।”

বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির অগ্রগতি

সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ এবং বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

এখন পর্যন্ত দেশে প্রায় ৭ মিলিয়ন সৌর হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সৌর প্রকল্পগুলোর একটি।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই খাতের উন্নয়ন ধীরগতিতে চলবে। জার্মানির মতো প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ দেশের সহায়তা তাই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ পরিবেশ

উপমন্ত্রী ইওহান সাটফ বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের প্রশংসা করে বলেন, “নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশই বিনিয়োগকারীদের আস্থা এনে দেয়। জার্মানি সেই আস্থা রেখেই বাংলাদেশের পাশে থাকতে চায়।”

তিনি উল্লেখ করেন, জার্মান বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তি, পোশাক, এবং প্রযুক্তি খাতে নতুন প্রকল্পে আগ্রহী।

বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত থাকবে

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। তবে ইওহান সাটফ জানান, জার্মানি বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং উত্তরণ প্রক্রিয়া যেন মসৃণভাবে হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে কাজ করবে।

তিনি বলেন, “আমরা চাই বাংলাদেশ যেন টেকসই উন্নয়ন অর্জন করে। উত্তরণ পরবর্তী সময়েও বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা অব্যাহত থাকবে।”

জার্মান সহযোগিতা বাংলাদেশের জ্বালানি ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “জার্মানি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিশ্বনেতা। তাদের সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশ শুধু জ্বালানি নিরাপত্তাই নয়, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নেও অগ্রগামী হবে।”

তিনি যোগ করেন, “বাংলাদেশে গ্যাস ও কয়লার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হলে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। জার্মান সহায়তা সেই পথ খুলে দিচ্ছে।”

টেকসই উন্নয়নের পথে নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশ এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে—যেখানে উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষা একসঙ্গে চলবে। জার্মানির সঙ্গে এই সহযোগিতা কেবল বিদ্যুৎ খাতে নয়, বরং একটি ‘সবুজ অর্থনীতি’ গড়ে তোলার পথ খুলে দেবে।

উপমন্ত্রী ইওহান সাটফের ভাষায়,
“আমরা চাই বাংলাদেশ শুধু উন্নয়ন করুক তাই নয়, বরং এমন উন্নয়ন করুক যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব।”

জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন আর একার লড়াই নয়—জার্মানির মতো উন্নত দেশের সহায়তায় এটি একটি বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের গল্প। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘স্মার্ট গ্রিড’ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়, তবে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থার রোল মডেল।

MAH – 13528 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button