প্রযুক্তি

আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের ১০ শিক্ষার্থী

Advertisement

বাংলাদেশের তরুণ মেধাবীরা আবারও বিশ্বমঞ্চে উড়তে যাচ্ছে দেশের পতাকা হাতে। আগামী ১৭ থেকে ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রোবোটিক প্রতিযোগিতা — ২৭তম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড (International Robot Olympiad – IRO)। এই মর্যাদাপূর্ণ আয়োজনে অংশ নিতে নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশের ১০ জন শিক্ষার্থী, যারা দেশজুড়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছে।

এই তরুণ প্রতিনিধিরা শুধু প্রতিযোগী নন, তারা বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের প্রতীক। তাদের হাতেই লুকিয়ে আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স এবং উদ্ভাবনের এক নতুন সম্ভাবনা।

সরকারি সহায়তায় বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ দলের এই যাত্রা সম্ভব হয়েছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সার্বিক সহায়তায়। আয়োজনটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন), যারা ২০১৮ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে আসছে।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিডিওএসএন জানায়, গত সাত বছরে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে মোট ৭৩টি পদক, যার মধ্যে ১৪টি স্বর্ণপদক, অর্জন করেছে। এটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীলতা, প্রযুক্তিতে পারদর্শিতা এবং বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতার দারুণ প্রমাণ।

২০২৫ সালের দলের গঠন ও সদস্যদের পরিচিতি

এই বছরের বাংলাদেশ দলটি বাছাই করা হয়েছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের বাংলাদেশ পর্ব থেকে। দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় শত শত শিক্ষার্থী অংশ নেয়। বাছাইপর্ব শেষে বিজয়ীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ১০ শিক্ষার্থী পাবে অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিযোগিতার মূল পর্বে অংশ নেওয়ার সুযোগ।

বাংলাদেশ দলের ২০২৫ সালের সদস্যরা হচ্ছেন—

  1. জুবাইদাহ জাফরিন — মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ
  2. নাফিয়া বাসার সুহানী — মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ
  3. মোহাম্মদ জারিফ বিন সালেক — ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ
  4. খোন্দকার মুশফিকুল ইসলাম — ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ
  5. মোহাম্মদ মাশরুর আরেফিন ভূঁঞা — ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ
  6. নুসাইবা তাজরিন তানিশা — ওয়াইডাব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়
  7. জাইমা যাহিন ওয়ারা — উইলিয়াম কেরি একাডেমি
  8. প্রিয়ন্তী দাস — স্কলাস্টিকা
  9. রিদোয়ান রাব্বানী — আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
  10. মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল টিটু — আনন্দ মোহন কলেজ

এই শিক্ষার্থীরা কেবল স্কুলের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়; তাদের রোবট বানানোর দক্ষতা, কোডিং জ্ঞান, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং দলগত নেতৃত্ব এখন আন্তর্জাতিক মানের। প্রতিযোগিতার জন্য তারা কয়েক মাসব্যাপী বিশেষ প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, যেখানে তারা শিখছে রোবট ডিজাইন, প্রোগ্রামিং, সেন্সর নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং-এর প্রাথমিক প্রয়োগ।

কোচ, নেতৃত্ব ও পরামর্শক দল

এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মিশাল ইসলাম এবং সহকারী কোচ এম তানজিম আল ইসলাম। দলের নেতৃত্বে থাকছেন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সভাপতি মুনির হাসান, যিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের তরুণদের উদ্ভাবনী চেতনা বিকাশে কাজ করছেন।

এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল উপস্থিত থাকবেন। তিনি নিজেও বাংলাদেশের রোবোটিক্স আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ এবং অসংখ্য তরুণ উদ্ভাবককে অনুপ্রাণিত করে আসছেন।

আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড: কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ

আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড (IRO) বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ রোবোটিক প্রতিযোগিতা। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথমবারের মতো এই আয়োজন শুরু হয়। এর মূল লক্ষ্য—বাচ্চা ও তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের আগ্রহ জাগানো, এবং বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে রোবটকে কীভাবে ব্যবহার করা যায় তা শেখানো।

প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন ধাপে অংশ নেয়—

  • রোবট ডিজাইন ও নির্মাণ
  • রোবট রেসিং ও চ্যালেঞ্জ
  • রোবট রেসকিউ ও হিউম্যানয়েড পারফর্মেন্স
  • কোডিং চ্যালেঞ্জ ও ইনোভেশন প্রজেক্ট

বাংলাদেশ দল এই বিভাগগুলোর একাধিকটিতে অংশ নেবে বলে জানা গেছে। প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করবে—কেউ রোবট ডিজাইন করবে, কেউ প্রোগ্রামিং করবে, কেউ বা রোবটের স্বয়ংক্রিয় চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে।

বাংলাদেশের পূর্বের অর্জন

২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। সেই বছর থেকেই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বিশ্বকে চমকে দিতে শুরু করে।
২০২৩ সালের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দল ৩টি স্বর্ণ, ৪টি রৌপ্য এবং ৬টি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে বিশ্বে সম্মানজনক অবস্থান দখল করে।
২০২৪ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২৬তম অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তাদের রোবট “অরবিটা” এবং “ট্রায়ো-বট” এর মাধ্যমে বিচারকদের মন জয় করে নেয়।

বিডিওএসএন-এর সভাপতি মুনির হাসান জানান, “বাংলাদেশের তরুণরা এখন কেবল মোবাইল অ্যাপ বা গেম খেলে সময় কাটাচ্ছে না—তারা এখন প্রযুক্তি তৈরি করছে। রোবট বানাচ্ছে, বিশ্বমঞ্চে প্রতিযোগিতা করছে। এটা এক নতুন যুগের সূচনা।”

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া মানে শুধু পদক জেতা নয়, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্মাণে অংশ নেওয়া। বাংলাদেশের এই তরুণরা প্রমাণ করছে, সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পেলে তারা আন্তর্জাতিক মানের উদ্ভাবক হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশে রোবোটিক্স চর্চা দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবোটিক্স ক্লাব, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কোডিং ক্লাব গড়ে উঠেছে। সরকারও “স্কুল অব ফিউচার”, “রোবোটিক্স ল্যাব”, এবং “স্টেম (STEM) শিক্ষা” চালু করেছে যাতে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের লক্ষ্য

অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টে আয়োজিত এবারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের লক্ষ্য শুধু অংশগ্রহণ নয়—বরং পদক জয় এবং দেশের নামকে প্রযুক্তির মানচিত্রে উজ্জ্বল করা। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বলেছে, “আমরা চাই, বিশ্ব জানুক—বাংলাদেশের তরুণরা রোবট তৈরি করতে পারে, উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে পারে।”

আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ মানে কেবল প্রতিযোগিতা নয়, বরং শেখা, উদ্ভাবন এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার এক বিশাল সুযোগ। বাংলাদেশের এই ১০ জন তরুণ শিক্ষার্থীই দেশের প্রযুক্তিগত ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা। তাদের সাফল্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে লক্ষ শিক্ষার্থীর জন্য, যারা স্বপ্ন দেখে—বাংলাদেশও হতে পারে একদিন “রোবোটিক্স হাব”।

MAH – 13525 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button