বানিজ্য

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি দামে গম আমদানি, যা বলছে সরকার

Advertisement

সম্প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আলোচিত একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির চুক্তি। অভিযোগ উঠেছিল, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে গম কিনছে। তবে এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে— আমদানির পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের অনিয়ম, অতিরিক্ত মূল্য প্রদান বা বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়নি।

মন্ত্রণালয়ের দাবি, বিষয়টি নিয়ে কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিভ্রান্তিকর এবং পাঠকদের ভুল ধারণা দিতে পারে। তাই তারা তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে।

বিতর্কের সূত্রপাত: “বেশি দামে গম আমদানি” শিরোনামের প্রতিবেদন

একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে “চুক্তির কারণে” আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি দামে গম কিনছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সরকার থেকে সরকার (G2G) পদ্ধতির মাধ্যমে গম আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

এই খবর প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন— কেন যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম রাশিয়া বা ইউক্রেনের তুলনায় বেশি, এবং কেন সেটিই বাংলাদেশ বেছে নিচ্ছে?

এই প্রেক্ষাপটে খাদ্য মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সরকারের অবস্থান ও প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: সবকিছু নিয়ম মেনে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) অনুযায়ী সরকার থেকে সরকার (G2G) পদ্ধতিতে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রথম ধাপে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন গম প্রতি টন ৩০২.৭৫ মার্কিন ডলারে ক্রয় করে।
পরে দ্বিতীয় ধাপে সমপরিমাণ গমের জন্য চুক্তি হয় ৩০৮ মার্কিন ডলারে

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, চুক্তির এই দাম আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ, বরং গুণমান ও পরিবহন ব্যয়ের দিক থেকে যৌক্তিক ও স্বচ্ছ।

রাশিয়া বনাম যুক্তরাষ্ট্র: তুলনা কি আসলেই সঠিক?

সংবাদ প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম রাশিয়ার গমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এই তুলনা একেবারেই ভুল ও বিভ্রান্তিকর

কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম নির্ধারণের সময় চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে পৌঁছানো পর্যন্ত সমস্ত খরচ—পরিবহন, বীমা, আনলোডিং, ও অন্যান্য বন্দরভিত্তিক চার্জ—অন্তর্ভুক্ত থাকে
অন্যদিকে, রাশিয়ার গমের মূল্য কেবল তাদের নিজস্ব বন্দরে পৌঁছানো পর্যন্ত হিসাব করা হয়, বাংলাদেশে পরিবহন বা আনলোডিং খরচ ধরা হয় না

অর্থাৎ, রাশিয়ার গমের দাম তুলনামূলক কম মনে হলেও বাস্তবে চূড়ান্ত খরচ প্রায় একই হয়, বরং অনেক সময় গুণমান ও সরবরাহ ঝুঁকির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গম বেশি নির্ভরযোগ্য।

আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের দাম যৌক্তিক

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে রাশিয়ার গমের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রতি টন প্রায় ২৩০ ডলার, আর যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম ২৩২ ডলার— পার্থক্য মাত্র ২ ডলার

তবে আমদানি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের গমে বন্দর পর্যন্ত পরিবহন ব্যয়, গুণমান নিশ্চয়তা, বীমা এবং সাইলো পর্যন্ত সরবরাহ খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকায় চূড়ান্ত মূল্য কিছুটা বেশি হয়, যা স্বাভাবিক ও বাজার-সম্মত

গুণগত মানে যুক্তরাষ্ট্রের গম এগিয়ে

খাদ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গমের মান ও পুষ্টিগুণের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের গম রাশিয়ার চেয়ে অনেক উন্নত
রাশিয়ার গমে সাধারণত ১১ শতাংশ প্রোটিন থাকে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের গমে ১৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রোটিন পাওয়া যায়।

এই উচ্চ প্রোটিনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গম রুটি, বিস্কুট, পাস্তা, ও বেকারি পণ্যের জন্য আদর্শ। এছাড়া গমের আর্দ্রতা, গ্লুটেনের গুণমান ও সংরক্ষণক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের গমে তুলনামূলক ভালো।

অতএব, পুষ্টিগুণ ও মান বিবেচনায় কিছুটা বেশি দাম হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক এবং ভোক্তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক

স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা হয়েছে

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির পুরো প্রক্রিয়াটি হয়েছে স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে
চুক্তির প্রতিটি ধাপ সরকারি অনুমোদন ও আর্থিক বিধিবিধান মেনে সম্পন্ন হয়েছে

এছাড়া জি-টু-জি পদ্ধতিতে কোনো দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী বা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীর সম্পৃক্ততা নেই। ফলে সরকারের ব্যয় কমেছে এবং গম সরবরাহও হয়েছে সময়মতো ও নির্ভরযোগ্যভাবে

বাংলাদেশে গম আমদানির প্রেক্ষাপট: কেন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন গমের প্রয়োজন হয়, যার বড় অংশ আমদানি করতে হয়। দেশীয় উৎপাদন সীমিত হওয়ায় বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, ইউক্রেন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে গম আমদানি করতে হয়।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক শিপিং সংকট, এবং নিষেধাজ্ঞাজনিত জটিলতার কারণে রাশিয়া থেকে সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি আমদানি একটি নিরাপদ ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে মাননিয়ন্ত্রণ কঠোর এবং খাদ্য নিরাপত্তা মানদণ্ড উচ্চ হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশ্বাসযোগ্য উৎস

বিশ্ববাজারের বাস্তবতা: পরিবহন ব্যয় ও মানের প্রভাব

বিশ্ববাজারে গমের দাম নির্ধারণে কেবল উৎপাদন খরচই নয়, বরং পরিবহন ব্যয়, রুটের নিরাপত্তা, বীমা প্রিমিয়াম, বন্দরচার্জ— এসব উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যেমন, ইউক্রেন বা রাশিয়া থেকে গম আনতে হলে কৃষ্ণসাগর হয়ে জাহাজ চলাচল করতে হয়, যা বর্তমানে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের গম সাধারণত প্যাসিফিক ও আটলান্টিক রুট দিয়ে নিরাপদভাবে আসে, ফলে সরবরাহের নিশ্চয়তা থাকে।

এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার যে নিরাপত্তা, মান ও সরবরাহ নিশ্চয়তা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছে, সেটি একটি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত

খাদ্য নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু দাম নয়, বরং গুণমান ও সরবরাহের স্থিতিশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় গমের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে— রুটি, নান, পাস্তা, বিস্কুটসহ নানা খাদ্যপণ্যে গম অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

তাই সরকার নিম্নমানের বা ঝুঁকিপূর্ণ উৎসের গমের ওপর নির্ভর না করে, উচ্চমানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য উৎস বেছে নিচ্ছে— যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ।

সরকারের বক্তব্যের সারাংশ

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে—

“যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও সরকার অনুমোদিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম, অতিরিক্ত দাম বা বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়নি।”

মন্ত্রণালয় আরও জানায়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন তথ্য বিকৃতি ও অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠকদের বিভ্রান্ত করছে। তাই তারা অনুরোধ করেছে, সংবাদ প্রকাশের আগে যাচাই-বাছাই করে তথ্য উপস্থাপন করা হোক।

বাংলাদেশে খাদ্য আমদানির প্রতিটি সিদ্ধান্ত দেশের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির বিষয়টি কেবল একটি ব্যবসায়িক চুক্তি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা কৌশলের অংশ

গমের মান, সরবরাহের নিশ্চয়তা, আন্তর্জাতিক পরিবহন পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা— এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করা একটি যৌক্তিক ও স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত, বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

MAH – 13510 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button