রাজধানীর মিরপুর শিয়ালবাড়িতে অবস্থিত একটি কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ আগুন লাগার ১২ দিন পর, রোববার নিহত মারজিয়া সুলতানার (১৪) মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে মেয়ের দেহ উদ্ধার করেন তারই বাবা সুলতান। সরকারি উদ্ধারকর্মীরা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও মরদেহটি খুঁজে বের করতে সক্ষম হননি। দীর্ঘ ১২ দিনের কষ্টকর অপেক্ষার পর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাবা নিজ হাতে মেয়ের দেহ শনাক্ত করেছেন।
বাবার সংগ্রাম ও চূড়ান্ত শনাক্তকরণ
নিহতের বাবা সুলতান প্রায় প্রতিদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান, মেয়ের খোঁজে ভবনের ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। প্রতি বার পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সতর্কবার্তার কারণে ব্যর্থ হন। মানবিক বিবেচনায় রোববার তাকে এবং পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে অনুমতি দেওয়া হয় ভবনের ভিতরে প্রবেশের। তৃতীয় তলায় পৌঁছে বাবা পরিচিত কাপড়ের একটি অংশ দেখে হতবিহ্বল হয়ে যান। এরপর টেবিলের নিচে রাখা একটি গেঞ্জির মধ্যে মেয়ের মরদেহের দেহাবশেষ খুঁজে পান।
পরিবারের বরাত অনুযায়ী, মরদেহ আগুনে পুড়ে মারা যায়নি। রাতেই মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ডিএনএ যাচাই শেষে মরদেহ পরিবারকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলবে বলে পুলিশ জানায়।
আগুন লাগার কারণ ও তদন্ত
শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগার পরপরই ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে অংশ নিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, এই ঘটনা একটি মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা। ভবনগুলোতে যথাযথ অনুমতি ছাড়া রাসায়নিক মজুত রাখা হয়, যা জনবহুল এলাকায় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, ঘটনাস্থলে ধোঁয়া ও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে ২৮ ঘণ্টার মধ্যে। তবে গোডাউনের ভেতরের ক্ষয়ক্ষতি এবং রাসায়নিকের অবস্থা এতটাই জটিল ছিল যে উদ্ধারকাজে আরও সময় লেগেছে।
ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার অভিযান
আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ভিতরে ধোঁয়া, ছাই এবং ক্ষয়ক্ষতির কারণে উদ্ধার কাজ ছিল জটিল। বিশেষ কেমিক্যাল স্যুট পরিধান করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত গোডাউনে প্রবেশ করেন। তারা ভেতরে থরে থরে রাখা রাসায়নিকের প্যাকেট ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পর্যালোচনা করেন।
পরিবারের অনুমতিতে ৭ সদস্যের দল ধ্বংসপ্রাপ্ত অফিসে প্রবেশ করে মরদেহ শনাক্ত করেন। এই উদ্ধার অভিযান পুরোপুরি মানবিক উদ্যোগের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
নিহতদের পরিবার ও প্রতিক্রিয়া
মিরপুর অগ্নিকাণ্ডে মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষ রয়েছে। স্বজনরা জানায়, এখনও অনেক লাশ হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে। নিহত মারজিয়ার বাবা বলেন, “১২ দিন ধরে মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আজ নিজ হাতে খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু এই কষ্ট কখনও শেষ হবে না।”
পরিবারের পাশাপাশি স্থানীয় সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে এই ঘটনার প্রতি দুঃখ ও উদ্বেগ রয়েছে। অনেকেই কেমিক্যাল গোডাউনের অনুমোদনহীন অবস্থান এবং নিরাপত্তার ঘাটতিকে দায়ী করছেন।
ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে মৃতক ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। বাবার এবং মেয়ের ডিএনএ মিল নিশ্চিত হলে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। পুলিশ জানায়, পুরো প্রক্রিয়া কিছুদিন সময় নিতে পারে। এছাড়া তদন্ত কমিটি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের সুপারিশ দেবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ প্রফেসর জিল্লুর রহমান বলেন, “শহরে জনবহুল এলাকায় অনুমোদন ছাড়া রাসায়নিক গোডাউন থাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ ধরনের দুর্ঘটনা পুনরায় না ঘটতে প্রশাসনকে কঠোরভাবে নজরদারি চালাতে হবে।”
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি যোগ করেন, “রাসায়নিক দুর্ঘটনা মানবজীবনের জন্য মারাত্মক। ভবিষ্যতে আইন মানা না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।”
মিরপুর শিয়ালবাড়ির অগ্নিকাণ্ড এবং মারজিয়ার দেহের ১২ দিনের পরে উদ্ধার মানবিক ও সামাজিক দিক থেকে দুঃখজনক ঘটনা। পরিবার ও সমাজের জন্য এটি এক কঠিন অভিজ্ঞতা। তদন্ত প্রক্রিয়া, ডিএনএ যাচাই এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এম আর এম – ১৯৭০,Signalbd.com



