রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর দগ্ধ সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাভিদ নেওয়াজ ৯৯ দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর অবশেষে বাড়ি ফিরেছেন। সোমবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “নাভিদের শারীরিক অবস্থা এখন অনেক ভালো। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরও সে পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসা নিতে আসতে পারবে। প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারও করা হবে।”
দুর্ঘটনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
গত ২১ জুলাই দুপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় মুহূর্তেই আগুন জ্বলে উঠে বহু শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও উপস্থিত লোকজনের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে।
দূর্ঘটনায় ৩৬ জন নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। নাভিদও ওই ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হন। তার শরীরের প্রায় ৪৫ শতাংশ অংশ দগ্ধ হয়েছিল। সে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার ইকবাল হোসেনের ছেলে।
নাভিদের চিকিৎসা প্রক্রিয়া
নাভিদকে দুর্ঘটনার পরপরই সিএমএইচ থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ও লাইফ সাপোর্টে রাখার প্রয়োজনের কারণে তার পরিবারকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছিল।
ডা. মারুফুল ইসলাম জানান, নাভিদের মোট ৩৬ বার ছোট-বড় অপারেশন হয়েছে। এর মধ্যে ৮ বার চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পর তাকে ২২ দিন আইসিইউতে রাখা হয়েছিল, এর মধ্যে ১০ দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। এরপর ৩৫ দিন হাইডিপেনডেন্সি ইউনিটে এবং পরবর্তী ৪০ দিন কেবিনে থাকার পর অবশেষে বাড়ি ফিরেছেন।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আপডেট
নাভিদ ছাড়পত্র পাওয়ার পরও বার্ন ইনস্টিটিউটে এখনও ৫ জন দগ্ধ শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, “এদের মধ্যে সবাই ভালো আছেন এবং শারীরিক উন্নতি হচ্ছে। আশা করা যায়, এক সপ্তাহের মধ্যে তারা সবাই বাড়ি ফিরবেন।”
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে এখন পর্যন্ত ৩১ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, এবং যারা ছাড়পত্র পেয়েছেন তারা প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য আসতে পারবে।
মানসিক প্রভাব এবং পুনর্বাসন
মাইলস্টোন দুর্ঘটনা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবে শিশু ও অভিভাবকদের উপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শিশুদের মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান বলেন, “অল্প বয়সে যে ট্রমাটা তারা পেয়েছে, তা দীর্ঘদিন ধরে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড ও কাউন্সিলিং জরুরি।”
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও বিমান বাহিনী যৌথভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নিয়েছে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও কাউন্সিলিং সেবা শিশুদের পুনর্বাসনে সাহায্য করছে।
স্কুল পুনরায় খোলার প্রস্তুতি
দুর্ঘটনার পর স্কুলটি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। তবে ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজ সেকশন চালু করা হবে এবং অন্যান্য শ্রেণির জন্যও পরে কার্যক্রম শুরু হবে।
স্কুলের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল জানান, “প্রথম দিনেই সরাসরি ক্লাস-পরীক্ষা হবে না। শোকসভা, মিলাদ মাহফিল এবং দোয়া আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে প্রস্তুত হবেন। এরপর ধাপে ধাপে লেখাপড়া শুরু হবে।”
সামাজিক ও জাতীয় প্রতিক্রিয়া
মাইলস্টোন দুর্ঘটনার প্রভাব কেবল স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নয়, পুরো জাতির উপর পড়েছে। বহু মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ঘটনার সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত হয়েছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবক ও শিক্ষকরা মানসিকভাবে আক্রান্ত। তাদের পুনর্বাসনের জন্য শোকসভা, কাউন্সেলিং এবং শিক্ষা কার্যক্রম ধাপে ধাপে পুনঃস্থাপন গুরুত্বপূর্ণ।”
৯৯ দিন হাসপাতালে কাটানোর পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা নাভিদের ঘটনা মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির একটি আশার আলো। যদিও দুর্ঘটনার শোক এবং ক্ষতি পুরোপুরি মুছে যাবে না, নাভিদের সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা পরিবার ও সমাজের জন্য প্রেরণার বিষয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পুনর্বাসন এবং মানসিক চিকিৎসা চালু থাকলে আহত শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন। তবে এই দুর্ঘটনার শিক্ষাগুলো ভবিষ্যতে স্কুল নিরাপত্তা ও জরুরি ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এম আর এম – ১৯৬৩,Signalbd.com



