বিশ্ব

সৌদি সফরে যাচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারা

Advertisement

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন থাকা সিরিয়া এবার সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে। আগামীকাল (২৮ অক্টোবর) ‘ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (FII)’ সম্মেলনে অংশ নিতে সৌদি আরবে যাচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারা। এই সফরকে শুধু বিনিয়োগ বা অর্থনৈতিক আলোচনা নয়, বরং আরব ঐক্য পুনর্গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্মেলন: মধ্যপ্রাচ্যের দৃষ্টি বিশ্বের দিকে

ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (FII)’ হলো সৌদি সরকারের এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প, যা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ সম্মেলন হিসেবে পরিচিত। এটি মূলত ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমানের “ভিশন ২০৩০” উদ্যোগের অংশ, যার লক্ষ্য—তেলের বাইরে সৌদি অর্থনীতিকে বহুমুখী করা এবং প্রযুক্তি, পর্যটন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ডিজিটাল বিনিয়োগ খাতে বিশ্বকে একত্র করা।

এ বছর সম্মেলনের নবম আসর অনুষ্ঠিত হচ্ছে রিয়াদের কিং আব্দুলআজিজ কনভেনশন সেন্টারে, যার প্রতিপাদ্য “সমৃদ্ধির চাবিকাঠি: মানবতার ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে”

এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার শীর্ষ বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক ও বিশ্বনেতারা অংশ নিচ্ছেন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য উদ্ভাবন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক সহযোগিতা।

সিরিয়ার প্রত্যাবর্তন: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বিনিয়োগের টেবিলে

দীর্ঘ ১২ বছরের গৃহযুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার পর সিরিয়া এখন ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরে আসছে। ২০২৩ সালে আরব লীগের সদস্যপদ ফিরে পাওয়ার পর এই প্রথমবার সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের সৌদি সফরকে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে এক “ঐতিহাসিক পুনর্মিলন” হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারা, যিনি ২০২৪ সালে সিরিয়ার নেতৃত্বে আসেন, দেশের পুনর্গঠন ও বৈদেশিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁর এ সফর সিরিয়ার অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের অংশ হিসেবেও বিবেচিত।

ক্রাউন প্রিন্স সালমানের সঙ্গে বৈঠক: আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে সহযোগিতা ও স্থিতিশীলতা

সৌদি আরবে অবস্থানকালে প্রেসিডেন্ট আল-শারা বৈঠক করবেন ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমানের সঙ্গে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আলোচনায় প্রধানত তিনটি বিষয় গুরুত্ব পাবে—
১. দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনর্গঠন,
২. বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি,
৩. আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা।

এছাড়া সিরিয়া ও সৌদির মধ্যে জ্বালানি, নির্মাণ, অবকাঠামো, কৃষি ও পুনর্গঠন প্রকল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব সিরিয়ার পুনর্গঠনে অংশ নিতে আগ্রহী, কারণ এটি মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির প্রভাব আরও দৃঢ় করবে।

উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল সঙ্গে থাকছে

প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারার সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে থাকছেন সিরিয়া সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বেশ কয়েকজন সদস্য, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও জাতীয় অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল।

এ দলটি বিভিন্ন বৈঠক ও সেমিনারে অংশ নেবে, যেখানে তারা সিরিয়ার পুনর্গঠন পরিকল্পনা, বিনিয়োগের ক্ষেত্র ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সুযোগ তুলে ধরবেন।

সিরিয়া-সৌদি সম্পর্কের ইতিহাস ও নতুন দিগন্ত

একসময় সিরিয়া ও সৌদি আরবের সম্পর্ক ছিল বেশ উষ্ণ। কিন্তু ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সৌদি সরকার বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরোধিতা করে। এরপর সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে যায়।

২০২৩ সালে আরব লীগের সদস্যপদ ফিরে পাওয়ার পর সৌদি আরবের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথ খুলে যায়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে কূটনৈতিক পর্যায়ে সীমিত যোগাযোগ শুরু হয়, আর ২০২৫ সালের এই সফরকে বলা হচ্ছে—“সম্পূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের দ্বারপ্রান্ত”।

বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব: নতুন ভারসাম্য গঠনের ইঙ্গিত

বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর শুধু সিরিয়া ও সৌদির জন্য নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যকার প্রভাব-প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
এই অবস্থায় সিরিয়ার সঙ্গে সৌদির ঘনিষ্ঠতা একদিকে আঞ্চলিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে এটি ইরান ও রাশিয়ার প্রভাব কমানোর কৌশল হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোরও আগ্রহ রয়েছে—সিরিয়া যেন পুনর্গঠনের পথে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পায়, যাতে চরমপন্থা ও শরণার্থী সংকট আরও না বাড়ে।

সিরিয়ার অর্থনীতি: বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত

গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ার অবকাঠামো ও শিল্পখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষি, জ্বালানি ও নির্মাণ খাতে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, সিরিয়া পুনর্গঠনে প্রয়োজন হবে কমপক্ষে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা একক কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন ও রাশিয়া যদি যৌথভাবে বিনিয়োগ করে, তাহলে সিরিয়ার পুনরুদ্ধার অনেক দ্রুত হতে পারে।

প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সিরিয়ার আগ্রহ

প্রেসিডেন্ট আল-শারা সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, “সিরিয়ার ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের ওপর নির্ভর করবে। আমরা এমন এক অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই যা যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন আশার আলো দেখাবে।”

তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যাবে FII সম্মেলনেও, যেখানে তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প, সৌরবিদ্যুৎ এবং প্রযুক্তি স্টার্টআপে সৌদি বিনিয়োগ আহ্বান করবেন।

বিশ্বের নজর রিয়াদে

ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন—

  • ইলন মাস্ক (টেসলা ও স্পেসএক্সের সিইও),
  • ক্রিস্টিন লাগার্ড (ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট),
  • জ্যাক মা (আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা),
  • ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী,
  • জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)-এর মহাসচিব প্রমুখ।

এত বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণে এই সম্মেলন কেবল বিনিয়োগ নয়, বরং বৈশ্বিক সহযোগিতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার এক মঞ্চে পরিণত হচ্ছে।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারার সৌদি সফর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক নতুন সূচনা। এটি কেবল দুটি দেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের ঘটনা নয়; বরং এটি সমগ্র অঞ্চলে স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ ও শান্তির পথে এক দৃঢ় পদক্ষেপ।

আসন্ন বছরগুলোতে এই সফরের প্রভাব সিরিয়ার অর্থনীতি, কূটনীতি ও জনগণের জীবনে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে—তা সময়ই বলে দেবে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, রিয়াদ সফরটি সিরিয়ার আন্তর্জাতিক প্রত্যাবর্তনের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।

MAH – 13500 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button