বিশ্ব

ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি পৌঁছাল বিমানবাহী রণতরিসহ এক মার্কিন যুদ্ধজাহাজ

Advertisement

লাতিন আমেরিকার উত্তাল সমুদ্র উপকূল এখন আবারও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রে। ভেনেজুয়েলার নিকটবর্তী ক্যারিবীয় সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানবাহী রণতরির উপস্থিতি বিশ্বজুড়ে নতুন এক সামরিক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর শক্তিশালী ডেস্ট্রয়ার ‘ইউএসএস গ্রেভলি’ (USS Gravely) পৌঁছেছে ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে। এই জাহাজটি বিশ্বের অন্যতম আধুনিক গাইডেড মিসাইল ধ্বংসকারী যুদ্ধজাহাজ, যা উন্নত রাডার, মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং আক্রমণক্ষমতায় সমৃদ্ধ।

এটি এমন এক সময়ে ঘটল, যখন ওয়াশিংটন ও কারাকাসের (ভেনেজুয়েলার রাজধানী) মধ্যে সম্পর্ক চরম উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই উপস্থিতি শুধু “যৌথ মহড়া” নয় — এটি লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি বার্তা।

দুই দৈত্য জাহাজ: ইউএসএস গ্রেভলি ও ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড

এই ঘটনার পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ‘ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড’ (USS Gerald R. Ford)। এটি যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর ষষ্ঠ নৌবহরের প্রধান শক্তি।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, এই রণতরিতে ৭৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান, উন্নতমানের রাডার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি যে পুরো ষষ্ঠ নৌবহর ওই অঞ্চলে মোতায়েন হয়েছে কিনা, তবে একাধিক সূত্র বলছে—ক্যারিবীয় অঞ্চলে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নৌ উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে ১৯৮৯ সালের পানামা আক্রমণের পর প্রথমবারের মতো।

‘যৌথ মহড়া’ নাকি যুদ্ধের প্রস্তুতি?

রবিবার স্থানীয় সময় সকালে ইউএসএস গ্রেভলি পৌঁছায় ত্রিনিদাদের রাজধানী পোর্ট অব স্পেনে। জাহাজে মার্কিন মেরিন সেনারাও ছিলেন, যারা একটি পরিকল্পিত যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর প্রতিরক্ষামন্ত্রী আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,

“আমাদের দেশের জনগণকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন যৌথ মহড়া নিয়মিত হয়। এটি যুদ্ধের কোনো ইঙ্গিত নয়।”

তবে স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বাজারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতেও আলোচনা একটাই—“এই যুদ্ধজাহাজগুলো যদি শুধু মহড়ার জন্য না হয়?”

ত্রিনিদাদের এক স্থানীয় বাসিন্দা আল জাজিরাকে বলেন,

“আমরা জানি না এটা আমাদের দেশের জন্য কী অর্থ বহন করে। কিন্তু যুদ্ধের খবর শোনার পর থেকে আমরা সবাই চিন্তায় আছি।”

মাদুরোর পাল্টা অভিযোগ: “আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন,

“ওয়াশিংটন ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কৃত্রিম অজুহাতে আমাদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করতে চায়।”

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে যে, তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র ‘ত্রেন দে আরাগুয়া’-এর পৃষ্ঠপোষক।
হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, এই চক্র দক্ষিণ আমেরিকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত, এবং মাদুরো নাকি এই চক্রের ‘রাজনৈতিক রক্ষাকবচ’।

তবে কোনো প্রমাণ ছাড়াই এই অভিযোগ এনেছে ওয়াশিংটন।
এ কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “মাদুরোকে চাপের মুখে ফেলতেই যুক্তরাষ্ট্র এখন সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে।”

মার্কিন প্রতিক্রিয়া: “আমরা কেবল নিরাপত্তা সহযোগিতা করছি”

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর (Pentagon) জানিয়েছে, তাদের উপস্থিতি “আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও মাদকবিরোধী কার্যক্রমের অংশ”।
প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র বলেন,

“ক্যারিবীয় অঞ্চলে আমরা মাদকবিরোধী অভিযান, মানবিক সহায়তা ও সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করি। এটি ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নয়।”

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৫ সালে যখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত বাড়ছে—ইউক্রেন, গাজা, দক্ষিণ চীন সাগর—তখন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ নতুন ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত দেয়।

বিশ্লেষকদের মত: “এটি শক্তি প্রদর্শনের কৌশল”

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক জাভেদ আলী বলেন,

“যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য স্পষ্ট—মাদুরো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এটি সরাসরি আক্রমণের প্রস্তুতি নয়, বরং একটি ‘শক্তি প্রদর্শন’ (Show of Force)।”

তিনি আরও বলেন,

“যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী যুদ্ধগুলোর ধরন দেখে বোঝা যায়, এত সীমিত উপস্থিতি নিয়ে তারা যুদ্ধ শুরু করে না। তবে এই সামরিক উপস্থিতি রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে যথেষ্ট।”

ভেনেজুয়েলার পাল্টা প্রস্তুতি: উপকূলে সামরিক মহড়া শুরু

ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ শনিবার ঘোষণা দিয়েছেন,

“আমাদের উপকূলে বৃহৎ সামরিক প্রতিরক্ষা মহড়া শুরু হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত।”

ভেনেজুয়েলার নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী যৌথভাবে ‘অপারেশন বোলিভারিয়ান শিল্ড’ নামের এক মহড়া শুরু করেছে, যেখানে যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন ও মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়েছে।

সরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, সৈন্যরা উপকূল বরাবর যুদ্ধ প্রস্তুতিতে নিয়োজিত, এবং যুদ্ধজাহাজগুলো “জাতীয় প্রতিরক্ষার প্রতীক” হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে।

পেছনের ইতিহাস: যুক্তরাষ্ট্র বনাম ভেনেজুয়েলা সম্পর্কের টানাপোড়েন

ভেনেজুয়েলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহু বছর ধরেই টানাপোড়েনে ভরা।
২০০২ সালে হুগো চাভেজের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা,
তারপর ২০১৯ সালে নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে “অবৈধ প্রেসিডেন্ট” ঘোষণা —
এসবই দুই দেশের সম্পর্কের ওপর গভীর ছায়া ফেলেছে।

অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, তেল রপ্তানিতে বাধা এবং মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ—সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করছে।

কিন্তু মাদুরো সরকার রাশিয়া, চীন ও ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে পশ্চিমা চাপ মোকাবিলা করছে।
এই কারণেই ওয়াশিংটনের চোখে কারাকাস একটি “বিপজ্জনক প্রভাবকেন্দ্র” হয়ে উঠেছে।

বিশ্ব প্রতিক্রিয়া: লাতিন আমেরিকা বিভক্ত

ব্রাজিল ও মেক্সিকোসহ লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশ এখন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন,

“লাতিন আমেরিকা যুদ্ধ চায় না। আমরা চাই শান্তি, সহযোগিতা ও সংলাপ।”

কিউবা ও নিকারাগুয়া, যাদের মাদুরোর ঘনিষ্ঠ মিত্র ধরা হয়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের “সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন” নিন্দা করেছে।
অন্যদিকে, কলম্বিয়া ও পেরু যুক্তরাষ্ট্রের “মাদকবিরোধী অভিযান” সমর্থন করেছে।

জনমত ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে “Caribbean Tension” নামে একটি নতুন শব্দ ঘুরছে।
টুইটার (এক্স) এবং ফেসবুকে #USWarship, #VenezuelaCrisis, #GeraldFordTrend ট্যাগে লক্ষাধিক পোস্ট হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকরা বলছেন—এই ঘটনা ভবিষ্যতে লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
যদি উত্তেজনা অব্যাহত থাকে, তাহলে ভেনেজুয়েলা উপকূলে ছোটখাটো সংঘর্ষও শুরু হতে পারে।

নতুন এক ঠান্ডা যুদ্ধের আভাস?

ভেনেজুয়েলা উপকূলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি শুধু সামরিক শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা নয়, এটি বিশ্ব রাজনীতির নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, তেল রাজনীতি, এবং মার্কিন প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লাতিন আমেরিকা এখন নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক খেলায় প্রবেশ করেছে।

বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোপুরি কূটনৈতিক সমাধানের ওপর নির্ভর করছে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলা সংলাপে বসে, তবে সংঘাত এড়ানো সম্ভব।
কিন্তু যদি উভয় পক্ষ শক্তি প্রদর্শনে অনড় থাকে, তবে ক্যারিবীয় উপকূল হতে পারে নতুন সংঘাতের মঞ্চ।

MAH – 13499 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button