কর্মসংস্থান

জাপানে এক লাখ দক্ষ কর্মী পাঠাবে বাংলাদেশ

Advertisement

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে নতুন চুক্তি—পরবর্তী পাঁচ বছরে এক লাখ দক্ষ কর্মী যাচ্ছেন জাপানে। নির্মাণ, কৃষি, গার্মেন্টস, এভিয়েশন ও কেয়ারগিভিংসহ নানা খাতে খুলছে কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত।

বাংলাদেশের তরুণ সমাজের জন্য জাপান হয়ে উঠছে নতুন এক কর্মসংস্থানের দিগন্ত। উন্নত প্রযুক্তি ও শৃঙ্খলার দেশ জাপান এবার বাংলাদেশ থেকে এক লাখ দক্ষ কর্মী নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও আরও উজ্জ্বল হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি জাপানের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক সংগঠন ‘ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-অপারেটিভস’ (এনবিসিসি)–এর ২৩ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায়।
সাক্ষাৎকালে প্রবাসী কল্যাণ ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার এসডিজি–বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।

চুক্তির মূল লক্ষ্য ও প্রেক্ষাপট

জাপানের এনবিসিসি ৬৫টিরও বেশি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক ফেডারেশন। সংস্থাটি সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (MoI) স্বাক্ষর করেছে, যার উদ্দেশ্য—বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেশন এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জাপানে প্রেরণ।

চুক্তির আওতায় আগামী পাঁচ বছরে ‘টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম (TITP)’ এবং ‘স্পেসিফাইড স্কিলড ওয়ার্কার্স (SSW)’ প্রকল্পের মাধ্যমে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি কর্মীকে জাপানে নিয়োগ দেওয়া হবে।

এটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক—কারণ এর মাধ্যমে দেশের দক্ষ কর্মীরা জাপানের উন্নত শিল্পক্ষেত্রে সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন।

পর্যায়ভিত্তিক নিয়োগ পরিকল্পনা

এনবিসিসি প্রতিনিধিদল জানিয়েছে, চুক্তির প্রথম ধাপে আগামী বছর (২০২৬) দুই হাজার দক্ষ কর্মী জাপানে পাঠানো হবে।
পরবর্তীতে ২০২৭ সালে ছয় হাজার এবং ২০২৮ সালে ১৮ হাজার কর্মী পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদে এই সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে, যা বাংলাদেশি শ্রমবাজারের জন্য বিশাল সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কোন কোন খাতে চাকরির সুযোগ?

জাপানের শিল্পখাতে বর্তমানে দ্রুত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর কারণে কর্মী সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন সেক্টরে বিদেশি কর্মীর চাহিদা বাড়ছে।

প্রাথমিকভাবে নিম্নলিখিত খাতগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা বেশি থাকবে:

  1. নির্মাণ খাত
  2. গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল খাত
  3. এভিয়েশন ও সেবা খাত
  4. কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ
  5. কেয়ারগিভিং ও নার্সিং সেক্টর
  6. অটোমোবাইল ও রিসাইক্লিং শিল্প

এই খাতগুলোতে বাংলাদেশের কর্মীরা ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এবার জাপানও সেই দক্ষতাকে কাজে লাগাতে চায়।

বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই জাপানে কর্মী পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে। খুলনা ও গাজীপুরের কাপাসিয়ায় দুটি আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে সম্ভাব্য কর্মীদের জাপানি ভাষা, সংস্কৃতি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

জাপানি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি কেন্দ্র দুটি পরিদর্শন করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এনবিসিসি চেয়ারম্যান মিকিও কেসাগায়ামা বলেন,

“আমি মার্চ মাসে কেন্দ্র দুটি দেখে গিয়েছিলাম। এবার এসে দেখছি অনেক উন্নতি হয়েছে। মাত্র সাত মাসে বিশাল অগ্রগতি হয়েছে, আমরা প্রশিক্ষণে খুবই সন্তুষ্ট।”

তবে তিনি ভাষাগত দক্ষতা বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন।

ভাষাগত চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস বলেন,

“ভাষাগত দক্ষতা অর্জনই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য ভার্চুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে জাপানি ভাষা শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। জাপান থেকে শিক্ষকরা অনলাইনে পাঠদান করবেন, আবার প্রয়োজনে তাদের বাংলাদেশেও আনা যেতে পারে।”

এই উদ্যোগের মাধ্যমে জাপানি ভাষা শেখার প্রক্রিয়া আরও সহজ ও কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশি নারীদের সম্ভাবনা: কেয়ারগিভিং সেক্টরে নতুন অধ্যায়

প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের নারীদের পরিশ্রম ও আন্তরিকতার প্রশংসা করে বলেন,

“কেয়ারগিভিং সেক্টরে বাংলাদেশের মেয়েরা অত্যন্ত দক্ষ। একটু ভাষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ পেলে তারা জাপানে অসাধারণ সাফল্য দেখাবে।”

এনবিসিসি প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, আগামী কয়েক বছরে জাপানে ৪ লাখের বেশি দক্ষ নার্স ও কেয়ারগিভারের প্রয়োজন হবে। তারা বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি নারী কর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

এটি বাংলাদেশের নারীদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে—যেখানে তারা শুধু নিজের পরিবার নয়, দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন।

সরকারের উদ্যোগ ও রোডম্যাপ

বৈঠকে প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন,

“সরকার ইতোমধ্যে জাপানে কর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করছে। শিগগিরই একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি হবে, যাতে দক্ষ কর্মী রপ্তানিতে কোনো জটিলতা না থাকে।”

তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ সেল (Special Cell) গঠন করা হয়েছে, যা জাপানে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করবে।

বাংলাদেশি অর্থনীতিতে প্রভাব

বাংলাদেশ বর্তমানে রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে অন্যতম।
জাপানে এক লাখ কর্মী পাঠানো হলে বছরে প্রায় ১.৫ থেকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিরিক্ত রেমিট্যান্স আসবে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন।

এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

দক্ষ কর্মী গঠনে সরকারের লক্ষ্য

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই ২০২৬ সালের মধ্যে অন্তত ২০ লাখ নতুন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
জাপানের এই চুক্তি সেই লক্ষ্য অর্জনে বড় ভূমিকা রাখবে।

তরুণদের জন্য এটি শুধু বিদেশে চাকরির সুযোগ নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনেরও বিরল সুযোগ।

ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে আগামী দশকে জাপানে বাংলাদেশি কর্মীদের অবস্থান শক্তিশালী হবে।
এতে করে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বৈচিত্র্যময় হবে এবং মধ্যপ্রাচিনির্ভরতা কিছুটা কমবে।

MAH – 13498 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button