বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬৩ জনে। একই সময়ে নতুন করে ১,১৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম।
মৃত্যু বাড়ছে, আক্রান্তের সংখ্যাও উদ্বেগজনক
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ২ জন, রাজশাহী বিভাগে ১ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ জন রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু সংক্রমণ কমার কথা থাকলেও উল্টোভাবে এটি আবার বেড়ে যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক।
চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৪৪০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর মাসেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে কয়েক হাজার রোগী।
বিভাগওয়ারি আক্রান্তের সংখ্যা
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন—
- ঢাকা বিভাগে: ২৮২ জন
- এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে: ১৬৫ জন
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে: ১৫৪ জন
- বরিশাল বিভাগে: ১৮৬ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগে: ১২১ জন
- খুলনা বিভাগে: ৬৫ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগে: ৫৬ জন
- রাজশাহী বিভাগে: ৫৬ জন
- রংপুর বিভাগে: ৫০ জন
- সিলেট বিভাগে: ৮ জন
দেশের প্রায় সব বিভাগেই নতুন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে চাপ। অনেক জায়গায় রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী শয্যা না থাকায় রোগীদেরকে করিডর বা বেডের নিচে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড়
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, অনেকে দেরিতে হাসপাতালে আসায় রোগের জটিলতা বাড়ছে।
একজন চিকিৎসক বলেন,
“অনেকেই প্রথম দুই দিন জ্বরকে সাধারণ মনে করে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু যখন রক্তে প্লাটিলেট কমে যায় বা শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তখন অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। তাই দ্রুত হাসপাতালে আসা উচিত।”
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেন বাড়ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বছর দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টি, আবর্জনা ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, এবং নগর এলাকায় অকার্যকর মশা নিয়ন্ত্রণের কারণে ডেঙ্গুর প্রজনন ক্ষেত্র বেড়ে গেছে।
ঢাকা ও অন্যান্য শহরে এখনো অনেক জায়গায় স্থির পানি জমে থাকে, যেখানে এডিস মশা সহজেই বংশবিস্তার করে।
জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন,
“এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সক্রিয় না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। প্রতিটি বাসা, অফিস ও নির্মাণাধীন ভবনে নিয়মিত পরিদর্শন জরুরি।”
ডেঙ্গুর ধরন ও লক্ষণ
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের দুইটি প্রধান ধরন — DEN-2 এবং DEN-3 বেশি সক্রিয়। এই দুই ধরনের সংক্রমণেই জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে।
ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণসমূহ:
- উচ্চ জ্বর
- চোখের পেছনে ব্যথা
- পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা
- বমি বা বমিভাব
- ত্বকে লালচে ফুসকুড়ি
তবে জটিল পর্যায়ে গেলে রোগীর রক্তে প্লাটিলেট কমে যেতে পারে, শ্বাসকষ্ট বা রক্তপাত দেখা দিতে পারে — যাকে বলা হয় ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার।
চিকিৎসা ও করণীয়
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন—
- জ্বর দেখা দিলে দ্রুত রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল খাবার গ্রহণ করা দরকার।
- নিজে থেকে ওষুধ না খাওয়া, বিশেষ করে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ পরিহার করা উচিত।
- জ্বর ২-৩ দিন স্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সরকারিভাবে সকল জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু চিকিৎসার বিশেষ ইউনিট চালু রাখা হয়েছে।
সচেতনতাই একমাত্র প্রতিরোধ
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা। এজন্য ঘরের আশেপাশে জমে থাকা পানি নিয়মিত ফেলে দিতে হবে, যেমন—
- ফুলের টব,
- পুরনো টায়ার,
- ফ্রিজ বা এসির নিচে জমে থাকা পানি,
- পানির ট্যাংক বা বালতি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রতিদিন লার্ভা ধ্বংস অভিযান পরিচালনা করছে বলে জানানো হয়েছে। তবে নাগরিকদের সহযোগিতা ছাড়া এটি কার্যকর করা সম্ভব নয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বর্ষা মৌসুম দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং শহরগুলোতে পানি নিষ্কাশনের সমস্যা বাড়ছে। এর ফলে এডিস মশার প্রজনন মৌসুমও দীর্ঘ হচ্ছে।
এই বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসেও নিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
নাগরিকদের সচেতনতার বার্তা
সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নিজে সচেতন হোন, পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন’ স্লোগানটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিন সকাল-বিকেলে মশা নিধনের স্প্রে করলেও, নিজের বাড়ি বা কর্মস্থল পরিষ্কার না রাখলে কার্যকারিতা শূন্য হয়ে যায়।
আশার আলো: আক্রান্তের হার কমার ইঙ্গিত
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অক্টোবরের শেষ দিক থেকে ধীরে ধীরে আক্রান্তের হার কিছুটা কমতে পারে, যদি আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। তবে নভেম্বরেও সতর্ক থাকতে হবে, কারণ ডেঙ্গু ভাইরাস এখন সারা বছরই সক্রিয়।
ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়— এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হয়েছে।
সরকারি উদ্যোগ, স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর তদারকি এবং নাগরিকদের সচেতনতা— এই তিনটি দিক সমন্বিতভাবে কাজ করলেই কেবল ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
“নিজের বাড়ি, নিজের দায়িত্ব। পানি জমতে দেবেন না, ডেঙ্গু হতে দেবেন না।”
MAH – 13493 I Signalbd.com



