বিশ্ব

আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় ক্যাথেরিন কনোলির

Advertisement

জনগণের আস্থা অর্জন করে দেশের তৃতীয় নারী প্রেসিডেন্টের আসনে তিনি

আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্যাথেরিন কনোলি ইতিহাস গড়েছেন। দেশের জনগণের আস্থাভাজন হয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী হেদার হামফ্রিস-কে পরাজিত করে ৬৩ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করেছেন ৬৮ বছর বয়সী এই নারী নেত্রী।
এ বিজয়ের মাধ্যমে তিনি আয়ারল্যান্ডের তৃতীয় নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখালেন।

ভোট ও ফলাফল ঘোষণা

গত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) আয়ারল্যান্ডের ৪৩টি নির্বাচনী এলাকায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোট গণনা শেষে শনিবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় ক্যাথেরিন কনোলির নাম।
নির্বাচনে তিনি পান প্রায় ১৮ লাখের বেশি ভোট, যা মোট বৈধ ভোটের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হেদার হামফ্রিস পান মাত্র ৯ লাখের মতো ভোট।

নির্বাচনের দিন দেশজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। রাজধানী ডাবলিন, গ্যালওয়ে, কর্‌ক, লিমেরিকসহ বিভিন্ন শহরে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে অংশ নেন। ভোটারদের উপস্থিতি ছিল প্রায় ৭২ শতাংশ, যা আয়ারল্যান্ডের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ।

ক্যাথেরিন কনোলি: এক দৃঢ়, সৎ ও মানবিক রাজনীতিক

ক্যাথেরিন কনোলি মূলত একজন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী। রাজনীতিতে তার যাত্রা শুরু হয় স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি আয়ারল্যান্ডের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডেইল এয়ারিন-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

তিনি সবসময়ই ছিলেন জনগণের কণ্ঠস্বর, বিশেষ করে নারীর অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশ সংরক্ষণে। তার নির্লোভ চরিত্র ও সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে আয়ারল্যান্ডের জনগণ তাকে “People’s President” বা “জনগণের প্রেসিডেন্ট” হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।

কনোলির প্রচারণা ছিল অত্যন্ত সরল ও মানবিক। তিনি বিশাল ব্যানার-পোস্টার নয়, বরং ছোট ছোট সভা-সমাবেশে জনগণের কথা শুনতেন। গ্রামের মানুষ, শ্রমজীবী, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার—সব শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন নিজের কথা ও স্বপ্ন নিয়ে।

অভিষেক ভাষণে ঐক্যের ডাক

বিজয় ঘোষণার পর রাজধানী ডাবলিন ক্যাসেলে অনুষ্ঠিত হয় অভিষেক অনুষ্ঠান। সেখানেই তিনি বলেন—

“আমি আয়ারল্যান্ডের প্রত্যেক নাগরিকের কথা শুনব, তাদের আশা ও ভয় বুঝব। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—এই দেশ হবে সকলের জন্য এক মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র।”

তার ভাষণে ছিল ঐক্য, সহানুভূতি ও মানবতার আহ্বান। তিনি উল্লেখ করেন, সমাজে বিভাজন নয়, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্মানই হবে নতুন আয়ারল্যান্ডের মূল শক্তি।

অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি. হিগিন্স, প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাডকার, পার্লামেন্ট সদস্যরা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিকেরা। অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী আইরিশ মিউজিক ও লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়, যা আয়ারল্যান্ডের সংস্কৃতিকে নতুন করে তুলে ধরে।

আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়

ক্যাথেরিন কনোলির বিজয় আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। তিনি এমন এক সময়ে ক্ষমতায় এলেন, যখন দেশটি অর্থনৈতিক বৈষম্য, আবাসন সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তার নেতৃত্বে আয়ারল্যান্ডে সমাজকল্যাণ ও টেকসই উন্নয়নের রাজনীতি আরও জোরদার হবে। তিনি সবসময় পরিবেশ সংরক্ষণ, সবুজ জ্বালানি, নারী নিরাপত্তা, এবং শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের পক্ষে কথা বলেছেন।

বিশ্লেষক প্যাট্রিক ও’সুলিভান বলেন,

“কনোলির বিজয় শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি সামাজিক জাগরণের প্রতীক। আয়ারল্যান্ডের মানুষ এমন এক নেত্রীকে বেছে নিয়েছে, যিনি সত্যিকার অর্থে তাদের পাশে দাঁড়ান।”

নারী নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা

ক্যাথেরিন কনোলির আগে আয়ারল্যান্ডে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দুই নারী—মেরি রবিনসন (১৯৯০–১৯৯৭) এবং মেরি ম্যাকএলিস (১৯৯৭–২০১১)
এই দুইজনই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কনোলির নির্বাচনে বিজয় সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।

নারীর নেতৃত্বে আয়ারল্যান্ড বারবার প্রমাণ করেছে যে দায়িত্বশীল ও মানবিক রাজনীতি কেবল সম্ভব নয়, সেটিই দেশের অগ্রগতির পথ।

কনোলির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি

নির্বাচনী প্রচারণায় কনোলি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  1. সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ: দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনমান উন্নয়নে উদ্যোগ।
  2. আবাসন সংকট সমাধান: প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সাশ্রয়ী ও নিরাপদ বাসস্থানের নিশ্চয়তা।
  3. সবুজ অর্থনীতি: নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও কার্বন নির্গমন হ্রাস।
  4. শিক্ষা সংস্কার: তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ ও কর্মসংস্থানে সক্ষম করে তোলা।
  5. স্বাস্থ্যখাতে সংস্কার: সরকারি হাসপাতালগুলোর মানোন্নয়ন ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণ।

তিনি বলেন,

“আমার লক্ষ্য ক্ষমতা নয়, সেবা। আমি রাজনীতি নয়, মানবিকতার জন্য কাজ করতে চাই।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

কনোলির বিজয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা অভিনন্দন জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, ফ্রান্স, জার্মানি ও কানাডার শীর্ষ নেতারাও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব এক বার্তায় বলেন,

“ক্যাথেরিন কনোলির নেতৃত্বে আয়ারল্যান্ড শান্তি, মানবতা ও জলবায়ু উদ্যোগে আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা করি।”

বাংলাদেশ থেকেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়,

“বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে আগ্রহী।”

জনগণের ভালোবাসা

কনোলির বিজয়ের রাতে রাজধানী ডাবলিনের রাস্তায় উৎসবের ঢল নামে। তরুণেরা হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে স্লোগান দেন—
“Catherine for Change!”,
অর্থাৎ “পরিবর্তনের জন্য ক্যাথেরিন!”

সোশ্যাল মিডিয়াতেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আয়ারল্যান্ডের নাগরিকরা তাকে “Hope of Ireland” বা “আয়ারল্যান্ডের আশার প্রতীক” বলে আখ্যা দেন।

ক্যাথেরিন কনোলির বিজয় শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়—এটি আয়ারল্যান্ডের জনগণের অন্তরের বিশ্বাস ও আশার প্রতিফলন
একজন নারী হিসেবে তিনি সমাজে যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা দেশের নতুন প্রজন্মের মধ্যে আস্থা জাগিয়েছে।

তার নেতৃত্বে আয়ারল্যান্ড আরও গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হবে—এমনটাই আশা করছে বিশ্ববাসী

MAH – 13478 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button