বাংলাদেশ

গুমের মামলায় ট্রাইব্যুনালে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল

Advertisement

আজ রোববার (২৬ অক্টোবর ২০২৫) দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে আবারও আলোচনায় এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বহু আলোচিত গুমের মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। সকাল থেকে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আজ এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউশন ও ডিফেন্সের আইনজীবীরা। আদালতে মামলার তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হতে পারে বলে নিশ্চিত করেছে প্রসিকিউশন সূত্র।

গুমের মামলার পটভূমি

গুমের এই মামলাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। মানবাধিকার সংস্থা ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

তদন্তে উঠে এসেছে, ২০২২ সালের দিকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কয়েকজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় দায়ের হয় একাধিক মামলা, যার মধ্যে অন্যতম এই গুম মামলা।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান আদালতে

আজ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে। আদালতে তার উপস্থিতি ঘিরে তীব্র আগ্রহ দেখা যায় সংবাদমাধ্যমের মধ্যে। জিয়াউল আহসান এর আগে সামরিক বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তদন্তে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর থেকেই তিনি আলোচনায় আসেন। আজকের শুনানিতে প্রসিকিউশন জিয়াউলের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত উপস্থাপন করতে পারে বলে জানা গেছে।

পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও অন্যদের ভূমিকা

এই মামলার অন্যতম আসামি শেখ হাসিনা বর্তমানে পলাতক। প্রসিকিউশন সূত্র জানায়, তাকে ধরতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে, তবে এখনো তার অবস্থান নিশ্চিত করা যায়নি।

একই মামলায় আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—

  • শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন,
  • কনস্টেবল সুজন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল।

এছাড়া, পলাতক রয়েছেন—

  • সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান,
  • যুগ্ম কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী,
  • রমনা জোনের ডিসি আকতার,
  • সহকারী কমিশনার ইমরুল

শহীদ আনাসসহ ৬ জন হত্যার মামলা: নতুন সাক্ষ্য

একই দিনে ট্রাইব্যুনালে চলছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। এটি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত চানখারপুল অভ্যুত্থানে শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে হত্যা করার ঘটনায় দায়ের করা মামলা।

এই মামলায় আজ ২০তম সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিচ্ছেন। এ মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজন পুলিশ কর্মকর্তা।

সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও। সবাই আদালতের বাইরে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় স্লোগান দেন— “আমরা চাই দোষীদের শাস্তি, গুম-হত্যার বিচার চাই।”

পূর্ববর্তী সাক্ষ্য ও আসিফ মাহমুদ সজীবের বক্তব্য

এর আগে, ১৬ অক্টোবর তারিখে দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন,

“আমরা এই দেশের মাটিতে কেউ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হব না। যারা এই হত্যাকাণ্ড ও গুমের সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে।”

তার সাক্ষ্য আদালতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে প্রসিকিউশন। তারা বলছে, এই সাক্ষ্য মামলার গতিপথে নতুন আলোকপাত করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: গুম ও বিচার ব্যবস্থার বাস্তবতা

আইন ও মানবাধিকার বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের মামলাগুলোর সুষ্ঠু বিচার শুধু অভিযুক্তদের শাস্তি নয়, রাষ্ট্রের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বলেন,

“গুমের ঘটনা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই একটি উদ্বেগের বিষয়। ট্রাইব্যুনালের এই উদ্যোগ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, যদি এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে পরিচালিত হয়।”

ফার্মগেট শহীদ গোলাম নাফিস হত্যা মামলার শুনানি আজ

আজই একই ট্রাইব্যুনালে আরেকটি আলোচিত মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি ফার্মগেইট শহীদ গোলাম নাফিস হত্যা মামলা।

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডে একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যের নাম উঠে এসেছে। প্রসিকিউশন আজ আদালতে মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানা গেছে।

ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা জোরদার

আজ সকালে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় দেখা গেছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন।
মিডিয়া প্রবেশেও ছিল সীমাবদ্ধতা। শুধুমাত্র নিবন্ধিত সাংবাদিকদেরই আদালতে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়।

নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,

“উচ্চপর্যায়ের আসামি ও সংবেদনশীল মামলা হওয়ায় বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।”

মামলার অগ্রগতি ও পরবর্তী কার্যক্রম

প্রসিকিউশন সূত্র জানিয়েছে, গুমের মামলায় তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী শুনানিতে তারা অভিযোগ গঠনের আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে পারে।

অন্যদিকে, শহীদ আনাস ও গোলাম নাফিস হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত থাকবে আগামী সপ্তাহেও। ট্রাইব্যুনাল প্রতিটি মামলাকে দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছে।

পরিবারগুলোর চোখে আশার আলো

গুম ও হত্যার শিকারদের পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে এই বিচার প্রক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। আজ আদালতে এসে তারা বলেন,

“বছরের পর বছর আমরা কাঁদছি। এখন শুধু চাই, অপরাধীদের বিচার হোক। আমাদের সন্তানের আত্মা শান্তি পাক।”

তাদের মুখে স্বস্তির হাসি না থাকলেও আজকের শুনানি তাদের মনে একটুখানি আশার আলো জ্বালিয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার দপ্তর থেকে এর আগেই বাংলাদেশে গুম-হত্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল।

দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই পদক্ষেপকে অনেক পর্যবেক্ষক “বিচারের পথে সাহসী উদ্যোগ” হিসেবে দেখছেন।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় গুম ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মামলা খুবই সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ প্রভাবশালী আসামিদের উপস্থিতি ও পলাতক অবস্থান—সবকিছু মিলিয়ে এই মামলা দেশের বিচার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আজকের শুনানি শুধু একটি মামলার নয়, এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতীক—যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আইনের শাসনের প্রতি আস্থা জাগাতে পারে।

MAH – 13477 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button