বাংলাদেশ

শান্তি-সহযোগিতা বাড়াতে জাতিসংঘকে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।

Advertisement

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক অভিমত ব্যক্ত করেছেন, যাতে তিনি বলেন যে শান্তি, বহুপাক্ষিকতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল বিশ্ব গড়তে গেলে জাতিসংঘ (UN)-কে অবশ্যই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকশিত হতে হবে।
আজ শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) জাতিসংঘ দিবস উপলক্ষে প্রস্তাবিত এক বাণীতে তিনি এসব কথা বলেন।

পরিবর্তনশীল বিশ্বে জাতিসংঘের ভূমিকা

উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “যদি জাতিসংঘ আমাদের সবার শান্তি ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার যৌথ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতার সঙ্গে অভিযোজিত হতে হবে। আমরা জাতিসংঘ সংস্কারের পক্ষে— যাতে এটি আরও গতিশীল, সমন্বিত এবং পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সবার প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়।”

তিনি বলেন, বিশ্ব আজ এমন এক সংকটপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে যেখানে ঘনঘন সংঘাত, মানবিক বিপর্যয়, উৎসবমুখর প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা ও জাতিগত উত্তেজনা সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠছে। এসব পরিস্থিতিতে ইউনিস এবং তার সদস্য রাষ্ট্রদের জন্য একদিকে সংকট মোকাবিলা করাই বড় চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে সেই সাথে সম্ভাবনা ও সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সদস্যপদ অর্জনের পর থেকে একটি সক্রিয়, দায়িত্বশীল ও অবদানশীল সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সংযোগ

উপদেষ্টা বলেন, “এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনে আমরা অঙ্গীকার করছি যে, জাতিসংঘ সনদে কল্পিত শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বিশ্ব গড়ে তুলতে বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে।”
তিনি আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সকল অংশীদার, সদস্য রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জাতিসংঘ দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন শান্তি মিশনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে — দেশ হিসেবে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছেন, বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা সংকটের মতো বিষয়গুলো আজ শুধু একটি দেশের সমস্যা নয় — তা সারা বিশ্বকে স্পর্শ করেছে।

বহুপাক্ষিকতা ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

ড. ইউনূস বলেন, “বহুপাক্ষীয় কূটনীতি এখন কঠিন পরীক্ষার মুখে রয়েছে। চরম জাতীয়তাবাদ ও মানবিক কষ্টের প্রতি উদাসীনতা মানবজাতির দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত অগ্রগতিকে ধ্বংস করছে।”
তিনি জানালেন, বর্তমান বিশ্বে শুধু দেশগুলো নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও নিজস্ব সংস্কার ও অভিযোজন অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে জাতিসংঘ-র মত বিশ্ব সংস্থাগুলোকে “সময়-মত” হতে হবে — নতুন বাস্তবতা, নতুন প্রযুক্তি, নতুন দক্ষতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে।

এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, জাতিসংঘ-র মধ্যে আরও বেশি গতিশীলতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিস্তৃত অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা আনা জরুরি। শুধু মিটিংয়ের জন্য মিটিং নয়, বরং বাস্তব পরিবর্তনের জন্য কার্যকর উদ্যোগগুলো নেওয়া প্রয়োজন।

শিখেছে কি বাংলাদেশ?

ইউনূস বলেন, “১৯৭৪ থেকে আমরা সদস্য। সেই থেকে আমরা চেষ্টা করেছি সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে। আজ আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে — বিশ্ব সফল হতে হলে অংশীদারিত্ব, শোষণ নয়, সহযোগিতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগণও এই মানসিকতা গ্রহণ করেছে — দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন যুক্ত হয়েছে ‘সুশাসন’, ‘প্রতিদান’ ও ‘স্বচ্ছতা’-র দাবি, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দায়িত্ববুদ্ধি গ্রহণ করছে।

তিনি উদাহরণ হিসেবে দেন, বাংলাদেশে শিক্ষিত, উদ্ভাবনী যুবসমাজ, গ্রামীণ উন্নয়ন, মাইক্রোফাইনান্সের মতো মডেল এবং আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এসব কাজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নিজেকে একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

সামনে কী রয়েছে?

ড. ইউনূস বলেন, “এই সময় আমরা শুধু একবার মন্তব্য করছি না — আমরা একটি অঙ্গীকার দিচ্ছি। সক্রিয়ভাবে কাজ করব যাতে বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়।”
তিনি বলছেন, আগামী সময়ের পরিকল্পনায় রয়েছে—

  • সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সমন্বয় এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
  • জাতিসংঘ-র কাঠামো ও প্রক্রিয়ায় অভিযোজন এনে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।
  • প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া।
  • রোহিঙ্গা সংকট, অভিবাসন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে পুনর্বাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণসহ বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর অংশগ্রহণ।
  • রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরণশীল দেশগুলোর জন্য ভূমিকা বাড়ানো যাতে বৈশ্বিক “নির্ভরশীলতা” ও “সহযোগিতা” আরও কার্যকর হয়।

বিশেষ বক্তব্য ও বিশ্লেষণ

উপদেষ্টা বলছেন, আজকের সময়ের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো — দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি, জলবায়ু বিপর্যয়, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি, যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংঘাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য। এসব একত্রে বিশ্বকে এমন এক অবস্থা নিয়ে এসেছে যেখানে পুরনো নিয়ম আর কাজ করছে না। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ-র ভূমিকা শুধু “মধ্যস্থতা” নয়, বরং “নেতৃত্ব”পূর্ণ হতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা তখনই কার্যকর হবে যখন অংশীদাররা শুধু চুক্তি ও চিত্রে থাকবেন না— তারা বাস্তবভাবে অংশ নেবেন, দায়িত্ব নিবেন। আজ প্রত্যেকটা দেশ এককভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারছে না— তাই করে নেওয়া প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এখানে এক ভালো দৃষ্টান্ত। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ শুধু নিজ দেশে উন্নয়ন করছে না, শান্তি মিশনে অংশ নিচ্ছে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নিয়োজিত। এই ধরনের “সহযোগিতামূলক দেশ” হিসেবে বিশ্বের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এসব বক্তব্য শুধু ঘোষণা নয় — এটি একটি আহ্বান। আহ্বান সবাইকে, আহ্বান রাষ্ট্র-সংস্থা-প্রশাসন-ব্যক্তি সবাইকে: চলুন একসাথে গড়ি এমন একটি বিশ্ব যেখানে শান্তি রয়েছে, বহুপাক্ষিকতা রয়েছে, এক-অপরের প্রতি সমঝোতা ও দায়িত্ব রয়েছে।
“সময় বদলেছে,” তিনি বলেন, “আর আমাদেরও বদলাতে হবে; শুধুই কথা নয়, কাজ করতে হবে।”
বাংলাদেশ এই পথচলায় প্রস্তুত— আর বিশ্বকেও প্রস্তুত থাকতে বলছে — কারণ শান্তি ও সহযোগিতার বিশ্ব গড়তে হলে সময়ের সঙ্গে তাল না মিলালে পিছিয়ে পড়বে।

MAH – 13456 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button