
গাজায় শান্তি রক্ষায় বিদেশি সেনা মোতায়েন নিয়ে তীব্র মতবিরোধে জড়িয়েছে ইসরায়েল ও মিসর,তুরস্ক । এতে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় দ্রুত অগ্রগতি, তবে তেলআবিব এখনও সব জিম্মির মরদেহ ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপে রাজি নয়।
ঘটনাট
গাজা উপত্যকায় বিদেশি সেনা মোতায়েন নিয়ে নতুন করে কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যে। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরুর আগেই এ বিরোধ প্রকাশ্যে আসায় মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মিসর যত দ্রুত সম্ভব গাজায় বিদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে চায়, অন্যদিকে ইসরায়েল বলছে— সকল জিম্মির মরদেহ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনো বিদেশি বাহিনীকে উপত্যকায় প্রবেশের অনুমতি দেবে না।
ইসরায়েল-মিসরের মধ্যে নতুন কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব
গত সপ্তাহে তেলআবিবে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিসরের গোয়েন্দা প্রধান হাসান রাশাদ ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে এ ইস্যুতে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (শিন বেত) প্রধান ডেভিড জিনি ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও।
সূত্র জানায়, গাজায় বিদেশি সেনা মোতায়েনের সময়সূচি ও গঠন কাঠামো নিয়েই মূল বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মিসর চায় দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী সেখানে মোতায়েন হোক, যাতে যুদ্ধবিরতির পর স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। কিন্তু ইসরায়েল বলছে, গাজায় এখনও হামাসের কিছু জিম্মির মৃতদেহ ফেরত আসেনি, তাই এখনই কোনো বিদেশি বাহিনী প্রবেশ করলে তদন্তে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
তুর্কি সেনা মোতায়েনে ইসরায়েলের আপত্তি
মতবিরোধের আরেকটি কেন্দ্রবিন্দু হলো তুরস্কের ভূমিকা। জানা গেছে, গাজায় প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক বাহিনীতে তুরস্ক অংশ নিতে চায়। কিন্তু ইসরায়েল এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে। নেতানিয়াহু সরাসরি নাম না উল্লেখ করলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন, তুরস্কের সেনা গাজায় থাকুক— এটি ইসরায়েল কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানায়, “গাজায় তুরস্কের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। এই বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার।”
এর আগে ফিলিস্তিনি সূত্রে জানা গেছে, মিসর ও জর্ডানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়েও ইসরায়েল আপত্তি জানিয়েছে। তারা মনে করে, এমন বাহিনী হামাসের প্রভাব পুরোপুরি নির্মূল করতে পারবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা
ইসরায়েল-মিসর বিরোধের মধ্যেই তিন দিনের সফরে ইসরায়েল পৌঁছেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। তিনি দুই দেশের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন এবং জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ দ্রুত বাস্তবায়িত হোক। তবে তা হতে হবে ধাপে ধাপে, পরিকল্পিতভাবে।
ভ্যান্স আরও বলেন, “পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত। হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে গাজায় কোনো মার্কিন সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনাও নেই।”
ওয়াশিংটন মনে করছে, বিদেশি সেনা মোতায়েনই এখন গাজায় দীর্ঘমেয়াদি শান্তির একমাত্র পথ, কিন্তু ইসরায়েলকে রাজি করানো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন কাজ।
যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ ও জিম্মি ইস্যু
বর্তমানে গাজায় চলছে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের কার্যক্রম। এই ধাপে হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি ও নিহতদের মরদেহ ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, হামাসের হাতে এখনও বেশ কিছু জিম্মির দেহাবশেষ রয়েছে, যা উদ্ধারে বিলম্ব হচ্ছে।
হামাসের দাবি, গাজার ভেতরে ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া মরদেহ উদ্ধার করা কঠিন এবং সরঞ্জামের অভাবে বিলম্ব হচ্ছে। তবে ইসরায়েল মনে করছে, এটি হামাসের সময়ক্ষেপণের কৌশল। তাই তেলআবিব স্পষ্ট জানিয়েছে, সকল মরদেহ ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে না।
সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক বাহিনীর কাঠামো
গাজায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে অংশ নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে মিসর, জর্ডান, আজারবাইজান, কাতার, ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্ক। এই বাহিনী যুদ্ধবিরতির পর উপত্যকার নিরাপত্তা, পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তার দায়িত্বে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের আপত্তির কারণে এই বাহিনীর কাঠামো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিশেষ করে তুরস্কের অংশগ্রহণ নিয়ে দ্বিধা থাকায় প্রকল্পটি স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল-মিসর বিরোধ শুধু গাজা নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গাজায় বিদেশি বাহিনী প্রবেশ না করলে পুনর্গঠনের কাজ ব্যাহত হবে, মানবিক সহায়তাও স্থবির হয়ে পড়বে। অপরদিকে ইসরায়েল যদি একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে মিসরসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠবে।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন প্রয়োজন সমঝোতা ও আস্থার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কারণ গাজা ইস্যুতে যে কোনো ভুল পদক্ষেপ পুরো অঞ্চলের শান্তি প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে পারে।
গাজায় বিদেশি সেনা মোতায়েন নিয়ে ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ এখন মধ্যপ্রাচ্যের নতুন উদ্বেগের কারণ। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, আর এতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে গাজার সাধারণ মানুষ। আগামী দিনগুলোতে মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা এই সংকটের সমাধানে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এম আর এম – ১৯০৯,Signalbd.com