
ইউক্রেনকে শক্তিশালী করতে এগিয়ে এল সুইডেন
রাশিয়ার চলমান আগ্রাসন ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনকে আরও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ১৫০টি অত্যাধুনিক গ্রিপেন যুদ্ধবিমান সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে সুইডেন।
এই ঘোষণা এসেছে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এক ঐতিহাসিক বৈঠকের পর।
বুধবার দক্ষিণ সুইডেনের লিনশপিং শহরে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে একটি ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ (Letter of Intent) বা ইচ্ছাপত্রে স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমে ইউক্রেনকে সর্বাধিক ১৫০টি জেএএস–৩৯ গ্রিপেন–ই (JAS-39 Gripen-E) যুদ্ধবিমান সরবরাহের সম্ভাবনা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে।
গ্রিপেন যুদ্ধবিমান: সুইডেনের গর্ব, ইউরোপের প্রতিরক্ষা শক্তির প্রতীক
‘গ্রিপেন’ শব্দের অর্থ হলো “গ্রিফিন” — একটি পৌরাণিক প্রাণী যার দেহ সিংহের, আর ডানা ঈগলের। নামের মতোই এই যুদ্ধবিমান গতি, নিখুঁততা ও স্থিতিশীলতার অনন্য সমন্বয়।
সুইডিশ প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান সাব (SAAB) এই যুদ্ধবিমান তৈরি করে।
১৯৯৬ সাল থেকে গ্রিপেন সক্রিয়ভাবে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে সুইডেন, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ আফ্রিকা ও থাইল্যান্ড–এর বিমানবাহিনীতে গ্রিপেন যুদ্ধবিমান রয়েছে।
গ্রিপেন–ই: ইউক্রেনের জন্য কী পরিবর্তন আনবে?
নতুন গ্রিপেন–ই মডেলটি (Gripen-E) হলো পঞ্চম প্রজন্মের উন্নত যুদ্ধবিমান। এতে রয়েছে:
- সর্বাধুনিক রাডার ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম
- স্মার্ট অস্ত্র বহনের ক্ষমতা
- গ্লোবালআই নজরদারি সিস্টেমের সাথে ইন্টিগ্রেশন সুবিধা
- কম জ্বালানি ব্যবহার ও উচ্চ গতিশীলতা
- অল্প সময়ের মধ্যে যেকোনো রণক্ষেত্রে উড্ডয়নের সক্ষমতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেন যদি এই ১৫০টি বিমান পায়, তবে রাশিয়ার বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিরোধে এটি একটি “গেম–চেঞ্জার” হতে পারে।
সুইডেনের অবস্থান: নিরপেক্ষতা থেকে সক্রিয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতায়
সুইডেন ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে। তবে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর ইউরোপে যে নতুন নিরাপত্তা বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে দেশটি নিজ অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে।
২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটো–তে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও সুইডেনের যোগদান কিছুটা বিলম্বিত হয়, ২০২৪ সালের মধ্যেই দেশটি পূর্ণ সদস্যপদ পায়।
এর পর থেকেই সুইডেন রাশিয়া–বিরোধী পশ্চিমা জোটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইউক্রেনকে এই যুদ্ধবিমান সরবরাহের ঘোষণা সেই অবস্থানেরই প্রতিফলন।
প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টারসনের বক্তব্য
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন বলেন,
“আমরা ইউক্রেনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গড়ে তুলছি। এই সহযোগিতা শুধুমাত্র একটি সামরিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি ইউরোপের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার প্রশ্ন।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“নতুন গ্রিপেন–ই যুদ্ধবিমান উৎপাদন ও সরবরাহে তিন বছর সময় লাগতে পারে। আমরা ইউক্রেনকে পুরোনো গ্রিপেন মডেলগুলো দ্রুত পাঠানোর বিষয়েও ভাবছি।”
জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়া: “ইউরোপ একসাথে দাঁড়িয়েছে”
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই চুক্তিকে “একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,
“আমরা শুধু যুদ্ধবিমান পাচ্ছি না — আমরা ইউরোপীয় ঐক্যের শক্তি দেখছি। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা একসাথে লড়ছি।”
জেলেনস্কি আরও জানান, এই সহায়তা ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের প্রতিক্রিয়া
সুইডেনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
একই সঙ্গে ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেন,
“সুইডেনের পদক্ষেপ ইউক্রেনের স্বাধীনতা রক্ষায় ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ঐক্যকে আরও শক্তিশালী করবে।”
তবে কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন, এই পদক্ষেপে রাশিয়া আরও আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া: “প্ররোচনামূলক সিদ্ধান্ত”
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,
“সুইডেনের এই পদক্ষেপ ইউরোপে অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ মানে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা।”
মস্কো জানিয়েছে, তারা এই সিদ্ধান্তের “উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া” দেবে।
রাশিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলোতে এটিকে “ন্যাটো–নির্দেশিত প্ররোচনা” বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: সাব–এর শেয়ারমূল্য বেড়েছে
সুইডেনের প্রতিরক্ষা কোম্পানি সাব (SAAB)–এর শেয়ারমূল্য এই ঘোষণার পরই ৩.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
বিগত কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়ে আসছে, বিশেষ করে গ্রিপেন–ই ও গ্লোবালআই সিস্টেমের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে।
বর্তমানে সুইডেন নিজেই ৬০টি নতুন গ্রিপেন–ই যুদ্ধবিমানের অর্ডার দিয়েছে, যার বেশিরভাগই লিনশপিং কারখানায় তৈরি হচ্ছে।
যুদ্ধের বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। রাশিয়ার দ্রুত বিজয়ের আশায় শুরু করা সেই অভিযান তিন বছরের মধ্যেই রূপ নেয় দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়বহুল যুদ্ধে।
ইউক্রেনের সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা ঠেকানো প্রায় অসম্ভব।
তাই এই ১৫০টি গ্রিপেন বিমান ইউক্রেনের জন্য হতে পারে যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর সুযোগ।
বিশেষ বিশ্লেষণ: ইউরোপের প্রতিরক্ষা ভারসাম্যে নতুন অধ্যায়
এই সিদ্ধান্ত শুধু ইউক্রেন–সুইডেন সম্পর্ক নয়, বরং সমগ্র ইউরোপের প্রতিরক্ষা ভারসাম্যে প্রভাব ফেলবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন:
- ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষমতা নাটকীয়ভাবে বাড়বে।
- রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে সামরিক চাপ বাড়বে।
- সুইডেন ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা নেতৃত্বে আরও প্রভাবশালী ভূমিকা নেবে।
- ন্যাটো–র আকাশ প্রতিরক্ষা কৌশল আরও শক্তিশালী হবে।
সুইডেনের এই ঘোষণা শুধু ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা জোরদার করবে না — এটি ইউরোপীয় ঐক্য ও সাহসেরও প্রতীক হয়ে থাকবে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেনকে সাহায্য করার এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় নিরাপত্তার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ভবিষ্যতে যুদ্ধের মোড় কোন দিকে যাবে তা সময়ই বলে দেবে, তবে একথা নিশ্চিত —
ইউরোপ এখন ইউক্রেনের পাশে, এবং আকাশে উড়বে গ্রিপেনের গর্জন।
MAH – 13454 I Signalbd.com