
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আজ যেন নতুন এক বাংলাদেশকে দেখছে দর্শকরা। আগের দুই ম্যাচে যেখানে রান তুলতে নাভিশ্বাস উঠেছিল, সেখানে আজ টাইগার ওপেনাররা যেন আগুন ঝরাচ্ছেন ব্যাট হাতে। সৌম্য সরকার ও সাইফ হাসান— দুই ওপেনারের ফিফটিতে দুর্দান্ত শুরু পেয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ১৭ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ ১১৭/০, কোনো উইকেট না হারিয়ে। সৌম্য ব্যাট করছেন ৫৫ বলে ৬২ রানে, আর সাইফ হাসান ৪৭ বলে ৫৩ রানে অবিচল। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি ছুঁয়ে নতুন মাইলফলক গড়লেন তরুণ ওপেনার সাইফ।
মিরপুরে ইতিহাস ছোঁয়া শুরু
মিরপুরের ধীরগতির উইকেটে এমন ঝোড়ো শুরু অনেকদিন পর দেখা গেল। ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েসের ১৪৭ রানের জুটি ছিল শেষবারের মতো এমন দাপট। আজ প্রায় এক দশক পর সেই ইতিহাস ছোঁয়ার পথে সৌম্য–সাইফ জুটি।
দুইজনেরই দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং—প্রথমে নিয়ন্ত্রিত, পরে আগ্রাসী। সৌম্য সরকারের কভার ড্রাইভ আর পুল শটগুলো যেন পুরোনো সেই রূপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্যদিকে সাইফ হাসান সতর্ক থেকেও সুযোগ পেলে শট খেলেছেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত, স্পিনে শুরু ওয়েস্ট ইন্ডিজের
বাংলাদেশ টস জিতে আজ আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়—যেটি ছিল একেবারেই কৌশলগত পদক্ষেপ। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মেহেদী হাসান মিরাজের দল সুপার ওভারে ১ রানে হেরে গিয়েছিল, ফলে সিরিজ এখন ১-১ সমতায়। তৃতীয় ও শেষ ম্যাচেই নির্ধারিত হবে সিরিজজয়ীর ভাগ্য।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ আজও তাদের স্পিন নির্ভর আক্রমণেই শুরু করে। প্রথম ওভারেই আকিল হোসেনের বলে দুটি চার মেরে সাইফ হাসান জানান দেন, আজ তারা ভিন্ন মেজাজে মাঠে নেমেছেন। পরের ওভারেই সৌম্য সরকার আরও তিনটি দারুণ বাউন্ডারি হাঁকিয়ে চাপটা সম্পূর্ণ উল্টে দেন।
রিভিউয়ে বেঁচে গেলেন সাইফ
১০ম ওভারে এক নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হয়। বাঁহাতি স্পিনার খ্যারি পিয়েরের বলে সাইফ হাসান পা বাড়িয়ে ডিফেন্স করতে গেলে বল লেগে যায় প্যাডে। আম্পায়ারের জোরালো এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্তে সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নেন সাইফ। টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় বল ব্যাটে লেগেছিল, ফলে নট আউট সিদ্ধান্তে বেঁচে যান তিনি। সেই থেকেই আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাট চালাতে থাকেন তরুণ ওপেনার।
স্পিনে কাজ না আসায় পেস আক্রমণ
ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক শাই হোপ স্পিনে কাজ না দেখে ১০ম ওভারে বল তুলে দেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার জাস্টিন গ্রেভসের হাতে। কিন্তু তিনিও সৌম্য–সাইফের ব্যাটে রেহাই পাননি। সৌম্য দুইটি পরপর চার মেরে জানান দেন, আজ কোনো ছাড় নেই।
আগের ম্যাচের হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো
দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ হেরেছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে। শেষ ওভারে ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে, যেখানে এক রানেই পরাজয় মেনে নিতে হয় মিরাজের দলকে। সেই আক্ষেপ মেটাতেই আজকের ম্যাচে মাঠে নেমেছে টাইগাররা।
মিরাজ ম্যাচ শুরুর আগে জানিয়েছিলেন, “আজ আমরা আগ্রাসী ক্রিকেট খেলব, ভয় পাব না। শুরুটা ভালো হলেই ফল আমাদের পক্ষে যাবে।” ঠিক সেটিই যেন বাস্তবায়ন হচ্ছে মাঠে।
কোচ ও বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং পরামর্শক ডেভিড হাম্পফ্রিস ম্যাচের আগে জানিয়েছিলেন, “আমরা ওপেনিংয়ে স্থিতিশীলতা চাই। সাইফ ও সৌম্য দুজনেই প্রস্তুত ছিল। আজ তারা সেটি প্রমাণ করছে।”
ক্রিকেট বিশ্লেষক আতহার আলী খান সিগন্যালবিডি-কে বলেন,
“বাংলাদেশ দল দীর্ঘদিন পর এমন একটি সূচনা পেল। যদি এই জুটি ২০–২৫ ওভার পর্যন্ত থাকে, তাহলে স্কোরবোর্ডে ৩০০ ছোঁয়া সম্ভব।”
গত ১০ বছরে মিরপুরে সেরা উদ্বোধনী জুটি
সাল | প্রতিপক্ষ | উদ্বোধনী জুটি | ওপেনাররা | ফলাফল |
---|---|---|---|---|
২০১৫ | জিম্বাবুয়ে | ১৪৭ | তামিম-ইমরুল | বাংলাদেশ জয় |
২০১৮ | ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ১২৩ | তামিম-লিটন | বাংলাদেশ জয় |
২০২১ | শ্রীলঙ্কা | ১০৪ | তামিম-নাঈম | বাংলাদেশ জয় |
২০২৫ | ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ১১৭+ (চলমান) | সৌম্য-সাইফ | চলমান |
এই তালিকায় দেখা যাচ্ছে, মিরপুরে যখনই বাংলাদেশের ওপেনাররা শতরানের জুটি গড়েছেন, তখন প্রায় সব ম্যাচেই জয় এসেছে।
সৌম্য সরকারের ফেরা
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলে অনিয়মিত ছিলেন সৌম্য সরকার। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পারফরম্যান্স করে ফিরে আসেন জাতীয় দলে। আজ সেই আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন ব্যাট হাতে। তাঁর ৫০টি রান এসেছে মাত্র ৪৪ বলে, যেখানে ৮টি চার ও ২টি ছক্কা।
সাইফ হাসানের প্রথম ফিফটি
দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় দলে নিয়মিত জায়গা পাচ্ছিলেন না সাইফ হাসান। তবে এই সিরিজে সুযোগ পেয়েই প্রমাণ করেছেন নিজেকে। আজ ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে ফিফটি করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ওপেনার হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করার ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি।
মিরপুরের উইকেট ও কৌশল বিশ্লেষণ
মিরপুরের পিচ আজ তুলনামূলকভাবে শুকনো ও কম বাউন্সি, যা স্পিনারদের জন্য সহায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের ওপেনাররা শুরু থেকেই ব্যাটে বলের চোখ রেখে খেলেছেন, স্পিনের ঘূর্ণি বুঝে এগিয়ে মারার কৌশল নিয়েছেন। এতে করে শুরু থেকেই রান রেট ৭-এর ওপরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ৫০ ওভারে ২৮০–৩০০ রান তুলতে পারলে এই উইকেটে জয় পাওয়া সহজ হবে।
সিরিজের প্রেক্ষাপট
- প্রথম ওয়ানডে: বাংলাদেশ ৬ উইকেটে জয়
- দ্বিতীয় ওয়ানডে: ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয় (সুপার ওভারে ১ রানে)
- তৃতীয় ওয়ানডে (চলমান): বাংলাদেশের দুর্দান্ত সূচনা
তিন ম্যাচের সিরিজে এখন সমতা ১–১। আজকের ম্যাচ জিতলেই সিরিজ নিশ্চিত করবে যে দল।
দর্শক ও সমর্থকদের উচ্ছ্বাস
মিরপুরে দুপুর থেকেই দর্শকের ঢল নামে। গ্যালারি ভর্তি টাইগার সমর্থকরা পতাকা হাতে উল্লাস করছেন। সৌম্য বা সাইফের প্রতিটি বাউন্ডারিতে উল্লাসে ফেটে পড়ছে গ্যালারি।
সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে ক্রিকেট উন্মাদনা। এক ভক্ত লিখেছেন,
“সৌম্য আজ পুরোনো রূপে ফিরে এসেছে। এমন বাংলাদেশকেই আমরা দেখতে চাই!”
পরবর্তী পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা
বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ চায় এই ম্যাচে দলের ফিল্ডিং ও বোলিং ইউনিটও সমান দায়িত্ব নিক। প্রথম ইনিংসে যদি ২৯০–৩০০ রান দাঁড় করানো যায়, তাহলে স্পিন আক্রমণ (মিরাজ, নাসুম, তাইজুল) ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা সম্ভব।
মিরাজ ম্যাচ-পূর্ব সাক্ষাৎকারে বলেন,
“এই ম্যাচটা শুধু সিরিজ জয়ের নয়, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ারও লড়াই। আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি।”
সংক্ষেপে ম্যাচের অবস্থা (১৭ ওভার শেষে)
- বাংলাদেশ: ১১৭/০ (১৭ ওভার)
- সৌম্য সরকার: ৬২ (৫৫ বল, ৮ চার, ২ ছক্কা)
- সাইফ হাসান: ৫৩ (৪৭ বল, ৭ চার)
- ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলাররা: আকিল হোসেন ৪-০-২৮-০, খ্যারি পিয়ের ৩-০-২০-০, গ্রেভস ২-০-১৮-০
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আজ প্রমাণ করছে, তারা শুধু ঘুরে দাঁড়াতেই পারে না, জবাবও দিতে জানে। সৌম্য ও সাইফের এই দারুণ সূচনা যদি বড় ইনিংসে রূপ নেয়, তাহলে মিরপুরে টাইগারদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ঐতিহাসিক সিরিজ জয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমীদের মুখে আজ একটাই স্লোগান—
“একটাই লক্ষ্য, জিতব আজ!”
MAH – 13451 I Signalbd.com