অর্থনীতি

প্রবাসী বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো এনবিআর

Advertisement

বাংলাদেশের লাখো প্রবাসী নাগরিকদের জন্য আসলো এক বড় সুখবর।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রবাসী করদাতাদের জন্য অনলাইন আয়কর রিটার্ন (E-return) দাখিল প্রক্রিয়া আরও সহজ করে দিয়েছে। এখন থেকে বিদেশে থাকা করদাতারা আর বাংলাদেশের সিম কার্ডের ঝামেলায় পড়বেন না — তাদের কাছে ওটিপি (One Time Password) পাঠানো হবে সরাসরি ই-মেইলে।

এনবিআরের সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এই উদ্যোগের ফলে প্রবাসীরা বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই সহজে ও নিরাপদে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।

কেন এই পরিবর্তন?

আগে অনলাইন রিটার্ন দাখিল করতে হলে করদাতাদের বাংলাদেশের সিম কার্ডে পাঠানো ওটিপি কোড ব্যবহার করতে হতো।
কিন্তু বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী করদাতাদের অনেকেরই বাংলাদেশি সিম সক্রিয় থাকে না। ফলে তারা এনবিআরের ই-রিটার্ন পোর্টালে লগইন বা নিবন্ধন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তেন।

এই জটিলতা দূর করতে এনবিআর এখন থেকে প্রবাসীদের নিবন্ধিত ই-মেইল ঠিকানায় ওটিপি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। অর্থাৎ, আর মোবাইল সিমের দরকার হবে না — শুধু ই-মেইলেই মিলবে লগইন কোড।

কীভাবে প্রবাসীরা ই-রিটার্নে নিবন্ধন করবেন?

এনবিআর জানিয়েছে, বিদেশে অবস্থানরত যে কোনো বাংলাদেশি করদাতা চাইলে এখন খুব সহজে ই-রিটার্ন পোর্টালে নিবন্ধন করতে পারবেন। এজন্য তাদের কিছু নথি (ডকুমেন্ট) ও তথ্য ই-মেইলে পাঠাতে হবে।

আবেদন পাঠানোর ঠিকানা:

[email protected]

প্রয়োজনীয় তথ্য ও কাগজপত্র:

  1. পাসপোর্ট নম্বর ও স্ক্যান কপি
  2. জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) নম্বর
  3. ভিসা বা রেসিডেন্স পারমিটের কপি
  4. নিজের স্পষ্ট ছবি (Passport size)
  5. সক্রিয় ই-মেইল ঠিকানা

এই তথ্য পাঠানোর পর এনবিআর প্রবাসী করদাতার ই-মেইলে একটি ওটিপি (One Time Password) এবং রেজিস্ট্রেশন লিংক পাঠাবে।
এরপর করদাতা সহজেই সেই লিংকে গিয়ে ওটিপি ব্যবহার করে নিজের একাউন্ট খুলতে পারবেন এবং আয়কর রিটার্ন দাখিল সম্পন্ন করতে পারবেন।

কারা অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সাম্প্রতিক আদেশ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন বেশিরভাগ করদাতার জন্য অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

তবে নিচের শ্রেণির করদাতারা এই বাধ্যবাধকতার বাইরে থাকবেন:

  • ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী করদাতা
  • শারীরিকভাবে অক্ষম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা
  • বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতা
  • বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক

অন্য সবাইকে এখন থেকে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতেই হবে।

প্রবাসীদের জন্য কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে।

এরা দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি।
তবে অনেক প্রবাসী দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় নিয়মিত কর রিটার্ন দাখিল করতে পারেন না।
ফলে তাদের ব্যাংক একাউন্ট, সম্পত্তি হস্তান্তর, বা বিনিয়োগ সংক্রান্ত নানা জটিলতা তৈরি হয়।

এনবিআরের এই নতুন উদ্যোগ প্রবাসীদের সেই সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করবে।

ই-রিটার্ন সিস্টেমের সুবিধা

ই-রিটার্ন পোর্টালটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে করদাতারা কয়েকটি ধাপে সহজে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন।

মূল সুবিধাগুলো হলো:

সুবিধাজনক: যেকোনো জায়গা থেকে ২৪ ঘণ্টা রিটার্ন দাখিল করা যায়।
স্বয়ংক্রিয় স্বীকৃতি: রিটার্ন জমা দেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ পাওয়া যায়।
ত্রুটি যাচাই: ফরম পূরণের সময় ভুল তথ্য দিলে সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা চিহ্নিত করে।
প্রিন্ট অপশন: করদাতা চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে আয়কর সনদ ও অন্যান্য প্রমাণপত্র প্রিন্ট নিতে পারেন।
নিরাপত্তা: ই-মেইল ভেরিফিকেশন ও ওটিপি ব্যবহারের কারণে তথ্য সুরক্ষিত থাকে।

কবে থেকে কার্যকর?

এনবিআর জানায়, প্রবাসীদের জন্য ই-মেইলে ওটিপি পাঠানোর এই নতুন সুবিধা ২০২৫ সালের অক্টোবর মাস থেকেই কার্যকর হয়েছে।
অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় থেকেই এই নিয়মে আবেদন করা যাবে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বাংলাদেশের কর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ প্রবাসী করদাতাদের জন্য “বাস্তবিক অর্থে যুগান্তকারী”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব হোসেন বলেন —

“দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীরা অনলাইনে কর রিটার্ন দিতে চাইলেও ওটিপি সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
ই-মেইল ভিত্তিক ব্যবস্থা চালু হলে হাজারো প্রবাসী এখন সহজেই নিজেদের করদাতা পরিচয় বজায় রাখতে পারবেন।”

অন্যদিকে, ট্যাক্স আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম বলেন —

“ই-রিটার্ন সিস্টেম শুধু সময় বাঁচায় না, বরং করদাতার আর্থিক লেনদেনকে আরও স্বচ্ছ করে।
প্রবাসীদের জন্য এটি করদাতার অধিকার রক্ষার এক বড় পদক্ষেপ।”

সরকারের লক্ষ্য: ডিজিটাল ট্যাক্স সিস্টেম

ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে এনবিআর গত কয়েক বছরে তাদের সেবা অনলাইনভিত্তিক করছে।
ই-ট্যাক্স, ই-রেজিস্ট্রেশন, অনলাইন চালান, কর পরিশোধ — সবকিছু এখন ধীরে ধীরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছে।

সরকারের লক্ষ্য, আগামী দুই বছরের মধ্যে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক — তিনটি খাতই সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল সিস্টেমে নিয়ে আসা।
এর ফলে কর আদায় আরও বাড়বে এবং সেবার মান উন্নত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কীভাবে ই-রিটার্ন দাখিল করবেন (Step-by-Step)

১️⃣ প্রথমে https://etaxnbr.gov.bd সাইটে প্রবেশ করুন।
২️⃣ “e-Return Registration” এ ক্লিক করুন।
৩️⃣ নিজের NID/Passport তথ্য দিন।
৪️⃣ প্রবাসী হলে “Overseas Taxpayer” অপশনটি নির্বাচন করুন।
৫️⃣ এনবিআর থেকে প্রাপ্ত ই-মেইল ওটিপি দিয়ে ভেরিফাই করুন।
৬️⃣ প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করে আয়কর রিটার্ন জমা দিন।
৭️⃣ রিটার্ন জমা শেষে প্রাপ্ত Acknowledgement Slip সংরক্ষণ করুন।

প্রবাসীদের কর সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা

এনবিআর জানিয়েছে, প্রবাসীদের জন্য পৃথক হেল্পডেস্ক ও ই-মেইল সাপোর্ট টিম গঠন করা হচ্ছে।
এছাড়া ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকেও কর রিটার্ন বিষয়ে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এনবিআরের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে এক যুগোপযোগী ও ইতিবাচক উদ্যোগ।
এটি শুধু কর রিটার্ন প্রক্রিয়া সহজ করবে না, বরং প্রবাসীদের জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করবে।
ডিজিটাল ট্যাক্স ব্যবস্থার এই অগ্রগতি বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে নেবে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এর পথে।

MAH – 13449 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button