
স্কয়ার ফার্মার রেকর্ড মুনাফা ও ঐতিহাসিক বিনিয়োগ ঘোষণ
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি তাদের ইতিহাসে একাধিক নতুন রেকর্ড গড়েছে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য ১২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার পাশাপাশি ৬৫০ কোটি টাকার বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।
এই বিনিয়োগের অর্থ ব্যয় হবে কোম্পানির কারখানা আধুনিকায়ন, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পে (BMR&E Project)—যা দেশের ওষুধ উৎপাদন খাতে আরও প্রযুক্তিনির্ভর ও রপ্তানিযোগ্য মানে উন্নীত করবে।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বুধবার (২২ অক্টোবর) কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে। পরদিন, বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় কোম্পানিটি।
আর্থিক প্রতিবেদনে উজ্জ্বল সাফল্য: সর্বোচ্চ মুনাফার রেকর্ড
স্কয়ার ফার্মার নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে কোম্পানিটি অর্জন করেছে কর-পরবর্তী সমন্বিত নিট মুনাফা ২,৩৯৭ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে একক বছরে সর্বোচ্চ।
এর মধ্যে এককভাবে (Standalone basis) কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছে ১,৪৭৪ কোটি টাকা। যদিও এটি আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৮৫ কোটি টাকা কম, তবুও কোম্পানির অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ খাতের সাফল্য মিলিয়ে মোট মুনাফা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
বিশেষ করে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে স্কয়ার ফার্মা শেয়ারবাজার ও আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করে ৬২১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫৬ কোটি টাকা বেশি। এছাড়া, কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও এসেছে ৩০২ কোটি টাকা মুনাফা, যা বছরওয়ারি তুলনায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি।
বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখবর: ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১২০% নগদ লভ্যাংশ
রেকর্ড মুনাফার ফলস্বরূপ, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালনা পর্ষদ বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ সুপারিশ করেছে।
এই ঘোষণার ফলে কোম্পানিকে মোট ১,০৬৪ কোটি টাকা লভ্যাংশ হিসেবে প্রদান করতে হবে।
লভ্যাংশের বণ্টন হবে নিম্নরূপ:
- উদ্যোক্তা–পরিচালকরা পাবেন: ৪৬৪ কোটি টাকা
- সাধারণ (ব্যক্তিশ্রেণির) বিনিয়োগকারীরা পাবেন: ২৮৫ কোটি টাকা
- বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পাবেন: ১৬১ কোটি টাকা
- প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পাবেন: ১৫৪ কোটি টাকা
বর্তমানে স্কয়ার ফার্মার শেয়ারের ৪৪ শতাংশ উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে, আর ২৭ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দখলে রয়েছে।
৬৫০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগে কী আসছে?
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নতুন বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, কারখানার আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা।
প্রকল্পের আওতায় থাকবে—
- নতুন উৎপাদন ইউনিট স্থাপন: আধুনিক মেশিনারিজ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সংযোজন।
- গুণগত মান বৃদ্ধির উদ্যোগ: আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে GMP (Good Manufacturing Practice) ও WHO অনুমোদন শক্তিশালী করা।
- ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশন: ওষুধ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও অটোমেটেড সিস্টেম যুক্ত করা।
- রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক লজিস্টিক সাপোর্ট: আন্তর্জাতিক বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ।
এই বিনিয়োগের মাধ্যমে স্কয়ার ফার্মা আগামী পাঁচ বছরে রপ্তানি আয়ে ২৫–৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য স্থির করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে স্কয়ার ফার্মার অবস্থান
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কোম্পানিটি দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে আসছে।
বর্তমানে স্কয়ার ফার্মার ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ৫০টিরও বেশি দেশে, যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, কেনিয়া ও ভিয়েতনাম অন্যতম।
বৈদেশিক বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য স্কয়ার ফার্মা ২০২৩ সাল থেকে “Square Lifesciences” নামে নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, যার মাধ্যমে জেনেরিক ওষুধ ছাড়াও বায়োটেক ও হারবাল প্রোডাক্টসের গবেষণা বাড়ানো হচ্ছে।
শেয়ারবাজারে স্কয়ার ফার্মার অবস্থান
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত স্কয়ার ফার্মার শেয়ারের দাম ছিল প্রতি শেয়ার ২৯০–৩০০ টাকার মধ্যে, যা ওষুধ খাতের সবচেয়ে স্থিতিশীল শেয়ারগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত।
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্কয়ার ফার্মা জনপ্রিয়, কারণ—
- কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদানের ইতিহাস ধারাবাহিক।
- আর্থিক স্থিতিশীলতা দৃঢ়।
- করপোরেট গভর্ন্যান্স ও স্বচ্ছতা বজায় রয়েছে।
- কোম্পানির কোনো ঋণনির্ভরতা নেই।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, স্কয়ার ফার্মার এই ৬৫০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের ঘোষণায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং শেয়ারমূল্যেও ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্কয়ার ফার্মার এই নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে নতুন যুগের সূচনা করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান বলেন—
“স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস দেশের শিল্পখাতে একটি ‘রোল মডেল’। তাদের এই বিনিয়োগ শুধু কোম্পানির প্রবৃদ্ধি নয়, বরং দেশের রপ্তানি আয়ে এবং কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখবে।”
ওষুধ শিল্পে এখন ‘Research-based Manufacturing’ এর দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।
স্কয়ার ফার্মা এই খাতে সবচেয়ে বেশি গবেষণা ব্যয় করছে, যা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মানের বায়োসিমিলার ও ইনোভেটিভ ড্রাগ উৎপাদনে সহায়ক হবে।
কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে প্রভাব
স্কয়ার ফার্মার এই নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২,০০০ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া, নতুন প্রযুক্তি ও মানসম্মত উৎপাদন প্রক্রিয়া দেশের তরুণ প্রকৌশলী ও ফার্মাসিস্টদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করবে।
উন্নয়ন, মুনাফা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সমন্বয়
বিষয় | তথ্য |
---|---|
মোট বিনিয়োগ | ৬৫০ কোটি টাকা |
মুনাফা (সমন্বিত) | ২,৩৯৭ কোটি টাকা |
নগদ লভ্যাংশ | ১২০% |
উদ্যোক্তা লভ্যাংশ | ৪৬৪ কোটি টাকা |
সাধারণ বিনিয়োগকারীর লভ্যাংশ | ২৮৫ কোটি টাকা |
রপ্তানি বাজার | ৫০+ দেশ |
কর্মসংস্থান | প্রায় ২,০০০ জন |
লক্ষ্য | প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ |
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
এই সাফল্যের পেছনে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৬৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ পরিকল্পনা শুধু স্কয়ার ফার্মার প্রবৃদ্ধিই নয়, বরং বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
রপ্তানি, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি—সবক্ষেত্রেই এই উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে নতুন উদ্যম যোগ করবে।
MAH – 13448 I Signalbd.com