
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের শান্ত শহর পঞ্চগড় হঠাৎই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার টিএনটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব মুফতি মুহিবুল্লাহ মাদানী নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর বৃহস্পতিবার সকালে তাকে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হেলিপ্যাড বাজার এলাকার রাস্তার পাশে একটি গাছের সঙ্গে লোহার শিকলে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এই ঘটনায় সারাদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন — এটা কি নিছক অপহরণ, নাকি ইসকনের দেওয়া হুমকিরই বাস্তব রূপ?
ঘটনার শুরু: ফজরের পর নিখোঁজ খতিব
মুফতি মুহিবুল্লাহ মাদানী টঙ্গীর ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের টিএনটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁর সহকর্মী ও স্থানীয় মুসল্লিদের মতে, তিনি শান্ত স্বভাবের, জনপ্রিয় এবং সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা প্রচার করতেন।
গত বুধবার ফজরের নামাজের পর প্রতিদিনের মতো হাঁটতে বের হন তিনি। কিন্তু এরপর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না, এমনকি তাঁর অবস্থানও কেউ জানাতে পারেনি।
এরপরই টঙ্গী পূর্ব থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে নিখোঁজের লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়।
ইসকনের হুমকি চিঠি: আতঙ্কের শুরু
এরও আগে, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে টিএনটি কলোনি জামে মসজিদের বারান্দায় পাওয়া গিয়েছিল একটি রহস্যময় হুমকি চিঠি। চিঠিতে ইসকনের নাম ব্যবহার করে লেখা হয়েছিল ভয়ঙ্কর বার্তা:
“তোদের খতিবকে ধীরে ধীরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে। শেষ অবধি তাকে একা বানিয়ে রাস্তার পাগল বানানো হবে। কারণ যোনি দেবী জগৎজয়ী কালী মাতা কাম দেবতার উপরে কেউ নেই। আজ হোক বা কাল হোক, পূর্ববাংলা ইসলামী মৌলবাদীদের মুক্ত করা হবে। আমাদের জনবলের সংকট নেই। তোদের বায়তুল মোকাররমকেও ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। এখন আর কথা নয়, আমরা অ্যাকশনে যাব।”
এই চিঠিতে একটি পাঞ্জাবি-টুপি পরা হুজুরের কার্টুন সদৃশ চিত্রও আঁকা ছিল, যার গলায় ছুরি ধরা অবস্থায় দেখানো হয়।
চিঠিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। মুহিবুল্লাহ মাদানী তখনও শান্তভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, “আমরা ভয় পাই না, আল্লাহর উপর ভরসা রাখি।”
কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পরই তিনি নিখোঁজ হন, যা ঘটনার সঙ্গে ওই হুমকির সম্ভাব্য সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলে।
পঞ্চগড়ে শিকলবন্দি অবস্থায় উদ্ধার
আজ বৃহস্পতিবার সকালে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হেলিপ্যাড বাজার এলাকার স্থানীয়রা প্রথমে বিষয়টি লক্ষ্য করেন। রাস্তার পাশে একটি বড় গাছের সঙ্গে লোহার শিকল দিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে তারা থানায় খবর দেন।
খবর পেয়ে পঞ্চগড় সদর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে খতিব মুফতি মুহিবুল্লাহ মাদানীকে উদ্ধার করে স্থানীয় সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, উদ্ধারকৃত মাদানীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, তবে তিনি জীবিত আছেন এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল্লাহিল জামান বলেন,
“আমরা খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই। মাওলানা মুহিবুল্লাহ মাদানীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁর বক্তব্য নেওয়ার পর বিস্তারিত জানা যাবে। প্রাথমিকভাবে এটি একটি পরিকল্পিত অপহরণের ঘটনা বলে মনে হচ্ছে।”
পরিবারের কান্না ও আশঙ্কা
মুফতি মুহিবুল্লাহ মাদানীর ছেলে মাওলানা আব্দুল্লাহ জানান,
“আমার বাবা নিখোঁজ হওয়ার আগে থেকেই ইসকনের হুমকি পাচ্ছিলেন। তাঁকে ভয় দেখানো হচ্ছিল ‘ভাগওয়া লাভ ট্র্যাপ’ নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকে। এখন তাঁকে যেভাবে শিকলবন্দি অবস্থায় পাওয়া গেল, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটি কোনো সাধারণ অপরাধ নয়।”
পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে সেই হুমকি চিঠিগুলোর সরাসরি যোগ থাকতে পারে। তাঁরা দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন।
ইসকনের পক্ষের প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনার পর স্থানীয় ইসকন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা হুমকি চিঠির বিষয়ে কোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে।
ইসকন ঢাকা বিভাগের এক মুখপাত্র বলেন,
“আমরা শান্তিপ্রিয় সংগঠন। কারও বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া বা অপহরণ করা আমাদের নীতির পরিপন্থী। কেউ আমাদের নাম ব্যবহার করে উস্কানি দিচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি তদন্ত করুক।”
তবে এই বক্তব্য জনমনে তেমন প্রভাব ফেলেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে দাবি করছেন, “এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ধর্মীয় বিভাজন তৈরির বড় ষড়যন্ত্র।”
ঘটনার পটভূমি: ইসকন ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
ইসকন বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কিছু অনুসারী ও কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
কিছু ইসলামিক বক্তা অভিযোগ করেন, ইসকনের কিছু সদস্য “ভাগওয়া লাভ ট্র্যাপ” নামে এক ধরনের ধর্মান্তর কার্যক্রমে যুক্ত, যা তরুণদের বিপথে নেয়ার চেষ্টা।
মুফতি মুহিবুল্লাহ মাদানীও সম্প্রতি এক আলোচিত ওয়াজ মাহফিলে “ইসকন ও ভাগওয়া লাভ ট্র্যাপ” বিষয়ে বক্তব্য রাখেন, যেখানে তিনি ধর্মীয় সচেতনতার আহ্বান জানান। এরপর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে লক্ষ্য করে একাধিক হুমকি ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য দেখা যায়।
পুলিশি তদন্ত ও রহস্যের দিক
পঞ্চগড় সদর থানা ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের যৌথভাবে এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, এটি পরিকল্পিত অপহরণ হতে পারে, যেখানে অপহরণকারীরা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তাকে দূরবর্তী এলাকায় নিয়ে যায়।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এছাড়া মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও অবস্থান (টাওয়ার ট্র্যাকিং) বিশ্লেষণ করা হবে।
ধর্মীয় সহাবস্থান ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠন, আলেম সমাজ ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা বলেন,
“বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এখানে কেউ যদি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়, তা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিহত করতে হবে। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি।”
অন্যদিকে কিছু মানবাধিকার সংগঠনও ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে, যাতে কোনো পক্ষকে অযথা দোষারোপ না করা হয়।
ইতিপূর্বে অনুরূপ হুমকি: আতাউল্লাহ বিক্রমপুরী ঘটনাও আলোচনায়
এ ঘটনায় অনেকে স্মরণ করেছেন, গাজীপুরেরই আরেক খতিব মাওলানা আতাউল্লাহ বিক্রমপুরীকে যিনি এক হিন্দু যুবকের হাতে মাদরাসা ছাত্রী ধর্ষণের বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন, তাকেও ইসকনের নামে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
এতে অনেকেই বলছেন, “একই ধরণের হুমকি, একই ধরণের টার্গেট — বিষয়টি এখন আলাদা ঘটনা নয়, বরং সংগঠিত আকারে চলছে।”
জনমতের প্রতিধ্বনি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষ লিখছেন:
- “এটা কেবল একজন খতিবের ওপর হামলা নয়, ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আঘাত।”
- “দোষীদের চিহ্নিত না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় কিছু ঘটতে পারে।”
- “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
অন্যদিকে কেউ কেউ আবার সতর্ক করছেন, “অপপ্রচার বা গুজবে বিশ্বাস না করে, তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষা করা উচিত।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা ব্যবস্থ
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও মসজিদগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির যেকোনো চক্রান্ত কঠোরভাবে দমন করা হবে।”
সত্য উদঘাটনের অপেক্ষ
মুফতি মুহিবুল্লাহ মাদানী এখন চিকিৎসাধীন। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে, তবে এখনো গ্রেফতার হয়নি কোনো ব্যক্তি।
পুরো দেশ তাকিয়ে আছে — কে বা কারা এমন নৃশংসভাবে একজন ধর্মীয় নেতাকে শিকলবন্দি করল? ইসকনের হুমকি চিঠি কি এর সঙ্গে জড়িত, নাকি এর আড়ালে আরও বড় কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে?
উত্তরটি সময়ই বলবে, তবে এই ঘটনা আমাদের সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
এই ঘটনাটি কেবল একজন খতিবের ওপর হামলা নয়, বরং আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের জন্য এক সতর্কবার্তা।
নাগরিকদের প্রত্যাশা — আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করবে।
MAH – 13446 I Signalbd.com