রাজনীতি

৭১ ইস্যুতে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন জামায়াত আমীর

Advertisement

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান এক ঐতিহাসিক স্বীকারোক্তিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ভুলের দায় নিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। বুধবার (২২ অক্টোবর ২০২৫) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে প্রবাসী সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন,

“শুধু ১৯৭১ নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের কর্মে, কথায়, বা সিদ্ধান্তে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি তাদের সবার কাছে বিনা শর্তে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”

ডা. শফিকুর রহমানের এই বক্তব্যকে অনেকেই জামায়াতের ইতিহাসে একটি মাইলফলক ঘটনা হিসেবে দেখছেন। দীর্ঘদিন পর প্রথমবারের মতো দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য এসেছে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ইতিহাসের প্রেক্ষাপট: একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী দলটি তৎকালীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং আল-বদর, আল-শামসসহ সহযোগী বাহিনী গঠনের অভিযোগে ব্যাপক সমালোচিত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই ইস্যুতে দলটি বিতর্ক, বিচার ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছে।

২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ও কার্যকর হন। এর মধ্যে ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান প্রমুখ।
তবে দল হিসেবে জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এসেছে, তারা “দেশ ও ইসলামের স্বার্থে ভুল বোঝাবুঝির শিকার” হয়েছে।

কিন্তু দলের বর্তমান আমীর ডা. শফিকুর রহমানের এই ক্ষমা প্রার্থনা অনেকের কাছে নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে।

ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য: “মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়”

নিউইয়র্কের সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াত আমীর বলেন,

“আমরা একটি আদর্শবাদী দল। কিন্তু মানুষ হিসেবে কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। ব্যক্তি যেমন ভুল করতে পারে, তেমনি একটি সংগঠনও ভুল করতে পারে। ইতিহাসই ঠিক করবে কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক।”

তিনি আরও বলেন,

“আজকে যেটাকে ভুল বলা হচ্ছে, কাল সেটাই হয়তো সঠিক প্রমাণিত হবে। তবে আমি মানবিক বিবেচনায়, নৈতিক দায়বোধ থেকে, বিনা শর্তে সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে কোনো পরাজয় নেই, বরং এটি দায়িত্ববোধের প্রকাশ।”

এই বক্তব্যের সময় তাঁর কণ্ঠে ছিল এক ধরনের আবেগ ও আত্মসমালোচনার সুর, যা উপস্থিত সাংবাদিক ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিক্রিয়া

নিউইয়র্কে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের কেউ কেউ এই বক্তব্যকে ‘ইতিহাসের একটি সাহসী পদক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যা দেন।
কেউ কেউ বলেন, “এটাই সময় ছিল, যখন অতীতের দায় স্বীকার করে সামনের দিকে এগোনো উচিত।”

তবে সমালোচকরাও পিছিয়ে নেই। অনেকেই বলেছেন, “ক্ষমা চাওয়াই যথেষ্ট নয়; জামায়াতকে তাদের অতীত ভূমিকার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ ও সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই বক্তব্যের পর দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান ও ভাবমূর্তি নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হবে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া

ডা. শফিকুর রহমানের এই বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন,

“ক্ষমা চাওয়া একটি ভালো দিক, তবে ইতিহাসের দায় মাফ করা যায় না। জামায়াতের উচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং যুদ্ধাপরাধীদের দায় থেকে নিজেদের আনুষ্ঠানিকভাবে আলাদা ঘোষণা করা।”

অন্যদিকে বিএনপির এক নেতা মন্তব্য করেন,

“রাজনীতিতে আত্মসমালোচনা জরুরি। যদি এটি আন্তরিক হয়, তাহলে এটি ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”

জামায়াতের অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের ভেতরেও ডা. শফিকুর রহমানের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে বিভিন্ন মতামত তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি দলের ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ

তবে দলীয় তরুণ নেতারা বলেছেন, “আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করে। ভুল থাকলে তা স্বীকার করেই আমরা সামনের দিকে এগোতে চাই।”

বিশ্লেষক মত: জামায়াতের রাজনীতিতে নতুন মোড়?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জামায়াতের এই প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা মূলত তাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা হতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে দলের নিবন্ধন নেই এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমও সীমিত।
তাই অনেকেই মনে করছেন, এই ধরনের মানবিক ও নৈতিক অবস্থান প্রকাশ করে দলটি হয়তো নতুনভাবে জনগণের কাছে নিজেদের উপস্থাপন করতে চায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক মন্তব্য করেন—

“ক্ষমা প্রার্থনা যদি আন্তরিক হয়, তবে এটি ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হতে পারে। কিন্তু সেটি প্রমাণ করতে হবে ধারাবাহিক কর্ম ও জনস্বার্থমূলক অবস্থানের মাধ্যমে।”

প্রেক্ষাপট: ডা. শফিকুর রহমান কে?

ডা. শফিকুর রহমান একজন চিকিৎসক এবং দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি ২০১৯ সালে দলের আমীর হিসেবে দায়িত্ব নেন।
তার আগে তিনি কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনীতিতে তিনি পরিচিত শান্ত ও নীরব স্বভাবের নেতা হিসেবে।
তবে তাঁর এই সাম্প্রতিক বক্তব্যে তিনি নিজেকে দেখিয়েছেন একজন আত্মসমালোচনামূলক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাজনীতিক হিসেবে।

জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড়

ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার মানুষ বিষয়টি নিয়ে মতামত দিচ্ছেন।

কেউ লিখেছেন,

“ক্ষমা চাওয়াটা সাহসের কাজ, যদি তা আন্তরিক হয়।”

আবার কেউ বলেছেন,

“ক্ষমা চেয়ে ইতিহাস পরিবর্তন হয় না, তবে ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যায়।”

এছাড়া তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ মন্তব্য করছেন,

“যদি সত্যিই দলটি পরিবর্তনের পথে হাঁটে, তাহলে এটি দেশের রাজনীতিতে নতুন সূচনা হতে পারে।”

ভবিষ্যতের প্রশ্ন: জামায়াত কি নতুন পথে?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখন দেখা জরুরি—জামায়াত ইসলামীর এই ক্ষমা প্রার্থনা কি শুধুই প্রতীকী, নাকি সত্যিই তারা নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গণতান্ত্রিক চর্চার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

যদি দলটি ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থান নেয়, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারে।

ইতিহাসের দায় স্বীকারই নৈতিক সাহস

ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে—‘ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে লজ্জা নয়, সাহস আছে।’

রাজনীতিতে আত্মসমালোচনার চর্চা যত বাড়বে, ততই উন্নত হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।
এখন সময়ই বলে দেবে, জামায়াত ইসলামীর এই “ক্ষমা প্রার্থনা” কতটা আন্তরিক ও কার্যকরভাবে ইতিহাসে স্থান পাবে।

MAH – 13445 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button