
উগান্ডার পশ্চিমাঞ্চলে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬৩ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও বহু মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। বুধবার (২২ অক্টোবর) মধ্যরাতে দেশটির কিরিয়ানদঙ্গ জেলার একটি ব্যস্ত মহাসড়কে দুটি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার পরপরই উদ্ধারকাজে নামে উগান্ডা রেডক্রস ও পুলিশ বাহিনী। আহতদের দ্রুত স্থানীয় হাসপাতাল ও আঞ্চলিক চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
কিভাবে ঘটল এই দুর্ঘটনা
স্থানীয় সময় রাত প্রায় ১২টার দিকে কিরিয়ানদঙ্গ জেলার মাসিন্দি–হোইমা মহাসড়কে দুটি বাস বিপরীত দিক থেকে আসছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একটি বাস অন্যটিকে ওভারটেক করার চেষ্টা করলে সামনাসামনি সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে, দুই বাসই মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
উগান্ডার সড়কগুলো তুলনামূলকভাবে সরু এবং অনেক জায়গায় বাঁকানো হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে বেশি। বিশেষ করে রাতে, হেডলাইটের আলোয় দৃশ্যমানতা কম থাকায় এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
রেডক্রসের বিবরণে ভয়াবহতার চিত্র
উগান্ডা রেডক্রসের মুখপাত্র আইরিন নাকাসিতা বলেন,
“এটি আমাদের দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর একটি। বহু যাত্রী গাড়ির ভেতরে আটকা পড়ে যান। অনেকে হাত-পা ভেঙে, রক্তাক্ত অবস্থায় চিৎকার করছিলেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমরা ৬৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করি, তবে আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা খুবই গুরুতর।”
তিনি আরও জানান, উদ্ধারকাজে স্থানীয় মানুষও সহায়তা করেছেন। বহু মানুষ মোবাইলের আলো জ্বেলে আহতদের বের করতে সাহায্য করেন।
পুলিশের বক্তব্য: “ভুল তালিকায় কিছু জীবিতও ছিল”
উগান্ডা পুলিশের মুখপাত্র ফ্রেড এনাঙ্গা সামাজিক মাধ্যম X (টুইটার)-এ দেওয়া এক পোস্টে জানান,
“দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক তালিকায় নিহতের সংখ্যা হয়তো কিছুটা বেশি দেখানো হয়েছিল, কারণ উদ্ধারকালে অনেকেই অচেতন ছিলেন। কয়েকজনকে মৃত ভেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, পরে তারা জীবিত অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছান।”
তবে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, নিশ্চিতভাবে ৬৩ জন নিহত হয়েছেন। আহতদের সংখ্যা প্রায় ৪০ জন বলে জানিয়েছেন তিনি।
আহতদের চিকিৎসা ও সরকারি সহায়তা
কিরিয়ানদঙ্গ জেলা হাসপাতাল ও মাসিন্দি রেফারেল হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা চলছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আহতদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর দগ্ধ হয়েছেন, কারও হাত-পা ভেঙে গেছে, আবার কেউ মাথায় আঘাত পেয়েছেন।
উগান্ডার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জরুরি চিকিৎসা সহায়তার জন্য অতিরিক্ত মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। এছাড়া নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
উগান্ডায় সড়ক দুর্ঘটনা: এক অনবরত দুর্যোগ
আফ্রিকার এই দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনা এখন একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর ২০২4 সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উগান্ডায় প্রতি বছর প্রায় ১২,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এর মধ্যে অধিকাংশ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে — অতিরিক্ত গতি, বেপরোয়া ড্রাইভিং, যানবাহনের খারাপ অবস্থা, ও পর্যাপ্ত সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব।
দেশটির প্রধান সড়কগুলো সরু ও পাহাড়ি, যেখানে ওভারটেক করা প্রায়ই প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরনো বাস ও ট্রাকগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটিও দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনা
দুর্ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে উগান্ডার নাগরিকরা সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, দেশটির পরিবহন খাতে পর্যাপ্ত সংস্কার ও তদারকি না থাকায় এমন দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম Daily Monitor জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত উগান্ডায় বড় ধরনের ১৫টির বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৪০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আফ্রিকাজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র
শুধু উগান্ডাই নয়, আফ্রিকার বহু দেশেই সড়ক দুর্ঘটনা এখন মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আফ্রিকায় প্রতি বছর প্রায় ২,০০,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। যা বিশ্বের মোট সড়ক মৃত্যুর প্রায় ২০%।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে নিরাপত্তা নীতি কার্যকর না হওয়া, ড্রাইভারদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকা, এবং যানবাহনের অনুপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণই এই বিপর্যয়ের মূল কারণ।
নিহতদের স্মরণে শোক ও প্রার্থনা
উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইওওয়েরি মুসেভেনি এক বিবৃতিতে নিহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন,
“আমরা যেসব প্রাণ হারিয়েছি, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। এই দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সড়ক নিরাপত্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করবে।”
সামাজিক মাধ্যমে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকেই নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও তদন্ত
পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ড্রাইভারদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও বাসগুলোর টেকনিক্যাল কন্ডিশনও পরীক্ষা করা হচ্ছে।
পরিবহন মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, আগামী মাস থেকে প্রধান মহাসড়কগুলোতে স্পিড মনিটরিং ক্যামেরা স্থাপন করা হবে এবং রাতের সময় ভারী যান চলাচলে নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে।
শিক্ষা ও করণীয়
এই দুর্ঘটনা শুধু একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, বরং আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এক বড় শিক্ষা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি উগান্ডা সরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নে কঠোরতা দেখায়, যানবাহনের মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে এবং চালকদের প্রশিক্ষণ জোরদার করে — তাহলে এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।
সড়ক দুর্ঘটনা এখন কেবল একটি মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ। উগান্ডায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর দেশের GDP-এর প্রায় ৫% ক্ষতি হয় বলে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে।
স্থানীয় মানুষের কণ্ঠ
ঘটনাস্থলের বাসিন্দা সামুয়েল নানসুবুগা, যিনি দুর্ঘটনার পর প্রথম উদ্ধারকারীদের একজন, বলেন,
“আমরা ভেবেছিলাম এটি হয়তো ছোটখাটো সংঘর্ষ। কিন্তু কাছে যেতেই দেখি সব ধ্বংসস্তূপ। কারও হাত নেই, কারও পা নেই। এমন দৃশ্য জীবনে কখনো দেখিনি।”
এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা স্থানীয় মানুষের মনে দাগ কেটে গেছে। অনেকেই বলেছেন, সরকারের উচিত এখনই সড়ক সংস্কারে বিনিয়োগ বাড়ানো।
উগান্ডার এই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা আবারও বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিল — নিরাপদ সড়ক শুধু উন্নত দেশের বিষয় নয়, বরং এটি প্রতিটি দেশের মানবিক ও অর্থনৈতিক টিকে থাকার প্রশ্ন।
যতক্ষণ না সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, ততক্ষণ এমন মৃত্যু আমাদের বারবার নাড়া দেবে।
MAH – 13441 I Signalbd.com