
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদ “গ্র্যান্ড মুফতি” হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন বিশিষ্ট ইসলামিক আলেম শেখ সালেহ বিন ফাওজান আল-ফাওজান। বুধবার (২২ অক্টোবর ২০২৫) সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়োগের নির্দেশ জারি করেন। দীর্ঘদিন ধরে এই মর্যাদাপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা শেখ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আল-শেখের মৃত্যুর পর শেখ ফাওজানকে নতুন গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
এই নিয়োগের মাধ্যমে সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃত্বে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। শেখ আল ফাওজান দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের “উলামা বোর্ড” বা “হায়া আল-কিবার আল-উলামা”-এর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইসলামী ফিকহ, আকিদা ও শরিয়াহর ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন আলেম হিসেবে মুসলিম বিশ্বের নিকট পরিচিত নাম।
শৈশব ও প্রাথমিক জীবন
শেখ সালেহ আল-ফাওজান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালে, সৌদি আরবের কাসিম অঞ্চলের একটি ছোট শহর আশ-শিমাসিয়াহতে। খুব অল্প বয়সেই তিনি তাঁর বাবা-মাকে হারান। শৈশবের কঠিন সময়েও তিনি শিক্ষার প্রতি অগাধ মনোযোগ বজায় রাখেন।
তাঁর প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় স্থানীয় মসজিদের ইমাম শেখ হাম্মুদ বিন সুলেমান আল-তিলাল-এর তত্ত্বাবধানে। তাঁর কাছেই শেখ আল ফাওজান সম্পূর্ণ কোরআন হিফজ করেন এবং ইসলামী শিক্ষা ও আরবি ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন।
উচ্চশিক্ষা ও একাডেমিক জীবন
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শেখ আল ফাওজান ভর্তি হন রিয়াদের বিখ্যাত “কলেজ অব শারিয়া” বা জামিয়াতুল শরিয়াহ রিয়াদ-এ। সেখানে তিনি ১৯৬১ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠান থেকে ইসলামী ফিকহে মাস্টার্স এবং পরবর্তীতে ডক্টরেট (PhD) ডিগ্রি অর্জন করেন।
তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল — ইসলামী উত্তরাধিকার আইন (Islamic Law of Inheritance) এবং খাদ্য ও ভোজ্যদ্রব্য সংক্রান্ত শরিয়াহ বিধান (Shariah Rulings on Food and Consumption)। এই দুটি বিষয়ই ইসলামী সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্কিত।
শিক্ষকতা ও ধর্মীয় দায়িত্ব
শিক্ষাজীবন শেষে শেখ ফাওজান রিয়াদের বিভিন্ন মাদরাসা ও শরিয়াহ ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি পরবর্তীতে রিয়াদ ইউনিভার্সিটি (বর্তমানে কিং সৌদ ইউনিভার্সিটি)-এর ফিকহ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
তাঁর জ্ঞান, নিষ্ঠা ও ইসলামী শরিয়াহর গভীর অনুধাবনের কারণে তিনি ধীরে ধীরে রাজকীয় ধর্মীয় পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন সৌদি আরবের “স্থায়ী ফতোয়া বোর্ড” (Permanent Committee for Scholarly Research and Ifta)-এর অন্যতম সদস্য।
এই বোর্ডটি পুরো সৌদি আরব জুড়ে ইসলামী ফতোয়া, শরিয়াহ আইন ও ধর্মীয় নীতিমালা নির্ধারণের দায়িত্বে থাকে। শেখ ফাওজান বহু বছর ধরে সেখানে কাজ করে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শরিয়াহ ভিত্তিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
ইসলামী চিন্তা ও মতবাদ
শেখ আল-ফাওজান সালাফি মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রতিনিধি। তাঁর শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর উপর অটল অনুসরণ। তিনি সর্বদা প্রচার করেছেন যে, ইসলামে নতুন উদ্ভাবন (বিদআত) ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা জরুরি।
তাঁর বক্তব্য ও বইগুলোতে দেখা যায় – তিনি একদিকে ইসলামী ঐতিহ্যের সংরক্ষণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অন্যদিকে আধুনিক সমাজে শরিয়াহর সঠিক প্রয়োগের ওপর জোর দেন।
লেখালেখি ও প্রকাশনা
শেখ সালেহ আল-ফাওজান অসংখ্য গ্রন্থের লেখক। তাঁর বইগুলো আরবি ভাষাভাষী বিশ্বের বাইরে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু বই হলো:
- شرح كتاب التوحيد (শরহ কিতাব আত-তাওহিদ) – ইসলামী একত্ববাদ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা।
- الإرشاد إلى صحيح الاعتقاد – সঠিক বিশ্বাস ও আকিদা বিষয়ে দিকনির্দেশনা।
- الملخص الفقهي (আল-মুলাখখাস আল-ফিকহি) – ইসলামী ফিকহ বা শরিয়াহ আইনের সংক্ষিপ্ত পাঠ।
- فتاوى الشيخ صالح الفوزان – ফতোয়া ও ধর্মীয় প্রশ্নোত্তরের সংকলন।
এই বইগুলো বিশ্বজুড়ে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও জনপ্রিয়তা
শেখ ফাওজান শুধু সৌদি আরবেই নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বে একজন প্রভাবশালী আলেম হিসেবে সম্মানিত। তাঁর বক্তৃতা ও দিকনির্দেশনা ইউটিউব, ইসলামিক স্যাটেলাইট চ্যানেল ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে লাখো মানুষ অনুসরণ করে।
তাঁর বক্তব্যগুলো সাধারণত ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, সমাজে নৈতিকতা, তরুণ প্রজন্মের দিকনির্দেশনা, এবং ইসলামী ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দেয়।
গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে দায়িত্ব
গ্র্যান্ড মুফতি সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পদ। এই পদে আসীন ব্যক্তিই পুরো দেশের ধর্মীয় নীতিনির্ধারণ, ফতোয়া প্রদান, এবং ইসলামী আদালত ও শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সার্বিক দিকনির্দেশনা দেন।
শেখ আল ফাওজান এই পদে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে শেখ আবদুল আজিজ আল-শেখের স্থলাভিষিক্ত হলেন, যিনি প্রায় তিন দশক ধরে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
রাজকীয় আদেশ অনুযায়ী, শেখ ফাওজান এখন থেকে “সৌদি আরবের ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল”, “ফতোয়া বোর্ড”, এবং “উলামা কমিটি”-এর নেতৃত্ব দেবেন।
রাজা সালমানের ঘোষণা
রাজা সালমান এক ঘোষণায় বলেন,
“শেখ সালেহ আল-ফাওজান দীর্ঘদিন ধরে আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর গভীর জ্ঞান, ধর্মীয় নীতির প্রতি আনুগত্য এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা তাঁকে এই মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব পালনে সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণ করেছে।”
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া
সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা শেখ ফাওজানের এই নিয়োগে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করেছেন।
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শেখ ফাওজানের এই নিয়োগকে ইসলামী নেতৃত্বে একটি ইতিবাচক ও জ্ঞাননির্ভর পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
ভবিষ্যৎ দায়িত্ব ও প্রত্যাশা
বিশ্ব মুসলিম সমাজ এখন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি — ধর্মীয় চরমপন্থা, ভুল ব্যাখ্যা, তরুণ প্রজন্মের বিভ্রান্তি, এবং আধুনিকতার সাথে ইসলামের ভারসাম্য রক্ষা।
শেখ সালেহ আল-ফাওজান এই জটিল সময়ে ইসলামী ঐক্য ও সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হতে পারেন।
শেখ সালেহ আল-ফাওজানের গ্র্যান্ড মুফতি পদে নিয়োগ শুধুমাত্র সৌদি আরবের জন্য নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তাঁর দীর্ঘ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড এবং শরিয়াহ-ভিত্তিক চিন্তাধারা ইসলামী জগতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি যে আদর্শ, শুদ্ধ আকিদা ও কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠার জন্য সারাজীবন কাজ করে গেছেন, এখন সেই দর্শনের পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেতৃত্ব দেবেন পুরো সৌদি আরবের ধর্মীয় দিকনির্দেশনায়।
MAH – 13439 I Signalbd.com