বিশ্ব

ইসরায়েলের পার্লামেন্টে পশ্চিম তীর দখলের বিল পাস

Advertisement

ইসরায়েল আবারও এক ধাপ এগোল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলের পথে। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) ইসরায়েলের পার্লামেন্ট ‘নেসেট’-এ পশ্চিম তীর দখলের একটি বিতর্কিত বিল প্রাথমিকভাবে পাস হয়েছে। এই বিলটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হলে পশ্চিম তীর আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে।

ফিলিস্তিন, আরব বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতোমধ্যেই এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিল কার্যকর হলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধান স্থায়ীভাবে বিপর্যস্ত হবে।

বিলের মূল প্রস্তাব: পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব

ইসরায়েলি পার্লামেন্টে উত্থাপিত বিলটির নাম “জুদিয়া ও সামারিয়া অঞ্চলে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ আইন”
এই দুটি অঞ্চলই মূলত পশ্চিম তীরের অংশ, যা ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল দখল করে রেখেছে।

নেসেটে বিলটি ২৫–২৪ ভোটে পাস হয়। যদিও ভোটের ব্যবধান ছিল খুবই কম, এটি ইসরায়েলি রাজনীতিতে একটি বড় বিভাজনের সূচক। এখন বিলটি সংসদের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটিতে পাঠানো হয়েছে পরবর্তী আলোচনার জন্য।

এটি কার্যকর হতে আরও তিন দফা ভোট প্রয়োজন। এরপর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর পেলেই আইন হিসেবে বলবৎ হবে।

নেতানিয়াহুর বিরোধিতা, তবুও জোটসঙ্গীদের সমর্থন

বিস্ময়করভাবে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিজেই এই বিলের বিরোধিতা করেছেন।
তার দল লিকুদ পার্টি বলেছে, এখনই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে।

নেতানিয়াহুর মতে,

“সার্বভৌমত্ব বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়, শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে নয়।”

তবে নেতানিয়াহুর কিছু জোটসঙ্গী ও ডানপন্থী বিরোধী নেতারা এই বিলের পক্ষে ভোট দেন। তারা যুক্তি দেন, পশ্চিম তীর “ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদের ভূমি”, তাই সেখানে ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।

মার্কিন প্রশাসনের স্পষ্ট বার্তা: অনুমতি নেই

এই ভোট অনুষ্ঠিত হয় এমন সময়ে, যখন মাত্র এক মাস আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন যে,

“ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার অনুমতি দেবে না।”

এছাড়া ভোটের দিনই মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ইসরায়েল সফরে ছিলেন, যেখানে তিনি গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করার বিষয়ে আলোচনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও জানিয়েছে,

“এই বিল আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের রেজুলেশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”

ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বের তীব্র প্রতিক্রিয়া

বিলটি পাস হওয়ার পরপরই ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায় —

“নেসেটের এই প্রচেষ্টা অবৈধ। পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা একক ভৌগোলিক ইউনিট। ইসরায়েলের এ অঞ্চলে কোনো সার্বভৌম অধিকার নেই।”

ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসও জানায়,

“এই বিল দখলদার ইসরায়েলের উপনিবেশবাদী চেহারা স্পষ্ট করে দিয়েছে। পশ্চিম তীর দখলের এই পদক্ষেপ অবৈধ, অগ্রহণযোগ্য এবং আগ্রাসনমূলক।”

কাতার এক বিবৃতিতে একে বলেছে,

“ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক অধিকারের প্রকাশ্য লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ।”

সৌদি আরব জানায়,

“রিয়াদ ইসরায়েলের সব ধরনের বসতি স্থাপন ও দখল প্রচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে।”

জর্ডান বলেছে,

“এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথে বাধা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে হস্তক্ষেপ।”

পশ্চিম তীরে এখন কতজন ইসরায়েলি বসবাস করে?

বর্তমানে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে প্রায় ৭ লাখের বেশি ইসরায়েলি অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে।
এই বসতিগুলো আন্তর্জাতিক আইনে “অবৈধ” ঘোষণা করা হলেও ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে সেগুলো সম্প্রসারণ করে চলেছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের হার গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল।
প্রতিদিন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ ও সামরিক চৌকি বসানোয় স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রা প্রায় অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব

এই বিল কার্যকর হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারণ, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাব্য ভূখণ্ড—পশ্চিম তীর—তখন পুরোপুরি ইসরায়েলের অধীনে চলে যাবে।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ড. ইউসেফ হামদান আল জাজিরাকে বলেন,

“এই পদক্ষেপ ইসরায়েলি চরমপন্থীদের রাজনৈতিক জয়ের প্রতীক। যদি আইন কার্যকর হয়, তাহলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন কবরস্থ হবে।”

ইসরায়েলি রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ বিভাজন

বিলটি ইসরায়েলি রাজনীতিতেও তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
ডানপন্থীরা এটিকে “ঐতিহাসিক অধিকার প্রতিষ্ঠা” হিসেবে দেখছে, অন্যদিকে উদারপন্থী ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিবিদরা বলছেন,

“এটি ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করে দেবে।”

কেন্দ্রীয় দলের এক এমপি বলেন,

“ইসরায়েল যদি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে পশ্চিম তীর সংযুক্ত করে, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বহু দেশ আমাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।”

জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন,

“ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের দখলকৃত ভূখণ্ডে সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে না।”

ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে,

“যদি এই বিল আইন হিসেবে কার্যকর হয়, তবে এটি ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।”

বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও বিক্ষোভ

বিলটি পাসের পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
তুরস্ক, লেবানন, মিশর, মালয়েশিয়াইন্দোনেশিয়াতে হাজারো মানুষ ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসে।

তারা স্লোগান দেয়:

“ফিলিস্তিনের মাটি ফিলিস্তিনিদেরই থাকবে”,
“দখলদার ইসরায়েল নিপাত যাক।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও #SavePalestine ও #BoycottIsrael ট্রেন্ডিং করছে।

ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের ভয়াবহ দিন

বিলটি পাসের খবর শোনার পর পশ্চিম তীরের শহরগুলোতে নেমে আসে উদ্বেগ ও হতাশা।
রামাল্লাহর এক বাসিন্দা জানান,

“আমরা প্রতিদিন ভয় নিয়ে বেঁচে আছি। এখন যদি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দখল ঘোষণা করে, আমাদের ভবিষ্যৎ শেষ।”

স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গত ছয় মাসে পশ্চিম তীরে প্রায় ৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায়।
অন্যদিকে হাজারো মানুষকে আটক করা হয়েছে “নিরাপত্তা হুমকি”র অজুহাতে।

বিশ্ব শান্তির জন্য আরেকটি বড় হুমকি

বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ কেবল ফিলিস্তিন নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যে এই ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন,

“এই বিল ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ সংঘাতের সূচনা করতে পারে, যার প্রভাব বিশ্বব্যাপী পড়বে।”

শান্তির বদলে নতুন অনিশ্চয়তা

ইসরায়েলের পার্লামেন্টে পশ্চিম তীর দখলের বিল পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তার সূচনা হলো।
একদিকে ইসরায়েলি ডানপন্থী রাজনীতিকদের উল্লাস, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণের কান্না ও ক্ষোভ—এই বৈপরীত্যই আজকের বাস্তবতা।

জাতিসংঘের আহ্বান সত্ত্বেও যদি ইসরায়েল এই পদক্ষেপ থেকে সরে না আসে, তবে আসন্ন দিনগুলোতে বিশ্ব আরও এক ভয়াবহ সংঘাতের মুখোমুখি হতে পারে।

MAH – 13438 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button