
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঐতিহাসিক জেনেভা ক্যাম্পে আবারও রক্তাক্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার দিবাগত গভীর রাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনাকর বিরোধের জেরে সংঘর্ষ শুরু হয়, যা মুহূর্তেই ভয়াবহ রূপ নেয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে ককটেল বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন মো. জাহিদ (২৫) নামের এক যুবক। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ
স্থানীয়রা জানান, বুধবার (২২ অক্টোবর) রাত সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ করেই জেনেভা ক্যাম্পের ৭ নম্বর ব্লকের রাস্তায় প্রচণ্ড শব্দে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তেই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাসিন্দারা জানালার আড়াল থেকে দেখতে পান, দুই গ্রুপের কয়েকজন যুবক একে অপরের দিকে ইটপাটকেল ও দেশীয় অস্ত্র ছুড়ছে। তাদের একজনের পায়ের কাছে হঠাৎ একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। পরে দেখা যায়, ওই যুবক মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। পরে জানা যায়, তিনি মো. জাহিদ — স্থানীয় এক মোবাইল সার্ভিসিং দোকানের কর্মচারী।
নিহত জাহিদের পরিবারে শোকের মাতম
নিহত জাহিদের বাড়ি জেনেভা ক্যাম্পেরই ৯ নম্বর ব্লকে। তার বাবা দীর্ঘদিন আগে মারা গেছেন, মা গৃহিণী। স্থানীয়রা জানান, জাহিদ ছিল শান্ত-স্বভাবের ছেলে। প্রতিদিন দোকান শেষে রাতে বাড়ি ফিরতেন। বুধবার রাতে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকায় প্রাণ হারাতে হয় তাকে।
জাহিদের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমার ভাই কোনো দলের সঙ্গে জড়িত না। সে শুধু দোকানে কাজ করত। রাতে বন্ধুর সঙ্গে একটু হাঁটতে বের হয়। হঠাৎ শুনি ককটেল ফাটছে, পরে দেখি ভাইকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটছে মানুষ।”
পুলিশের বক্তব্য
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, “রাতে ককটেল বিস্ফোরণে গুরুতর আহত অবস্থায় জাহিদকে ঢামেকে আনা হয়। ভোরের দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে রাখা হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “ঘটনার পরপরই মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সংঘর্ষে কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
সংঘর্ষের কারণ কী?
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, জেনেভা ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে দুই যুবগোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। এলাকায় অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ, ভাড়া বণ্টন ও ব্যবসায়িক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই এই ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে।
একজন স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ বলেন, “আমরা বহুবার প্রশাসনকে বলেছি যেন এলাকায় নিয়মিত টহল বাড়ানো হয়। কিন্তু প্রতিবারই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আসে পুলিশ। এরপর আবার পুরনো অবস্থা ফিরে আসে।”
সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাতে দুই গ্রুপের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় এক বন্ধুর মোটরসাইকেল নিয়ে। ধীরে ধীরে সেটি মারামারিতে গড়ায়। এরপরই শুরু হয় ককটেল বিস্ফোরণ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ।
জেনেভা ক্যাম্পের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি
১৯৭১ সালের পর থেকে জেনেভা ক্যাম্প মূলত “বিহারী শরণার্থী ক্যাম্প” হিসেবে পরিচিতি পায়। এখানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করেন। অধিকাংশের নাগরিকত্ব ও পুনর্বাসন জটিলতা আজও পুরোপুরি সমাধান হয়নি।
বছরের পর বছর ধরে এখানে অপরাধপ্রবণতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মাদক ব্যবসা বেড়ে চলেছে। এলাকার বাসিন্দারা প্রায়ই অভিযোগ করেন, প্রশাসনের তদারকি না থাকায় যুব সমাজের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাই ও মাদক কারবারে।
জেনেভা ক্যাম্পের এক বাসিন্দা নাসির হোসেন বলেন, “আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। কিন্তু এখানে কিছু অসাধু লোক রাজনীতি আর দখলবাজির নামে এলাকায় ভয়ভীতি ছড়ায়। প্রশাসন চাইলে এই এলাকা অনেক আগেই শান্ত করা যেত।”
প্রশাসনের তৎপরতা বৃদ্ধি
ঘটনার পরপরই মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ক্যাম্পের ভেতরে অভিযান চালায়। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) বলেন, “আমরা ঘটনাটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটি পূর্বশত্রুতার জের ধরে সংঘর্ষ। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।”
তিনি আরও জানান, “এলাকায় সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের কাজ চলছে। জাহিদের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা প্রস্তুতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”
স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ
ঘটনার পর পুরো জেনেভা ক্যাম্পজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা দোকান খুলছেন দেরিতে।
স্থানীয় দোকানদার রফিক মিয়া বলেন, “প্রতিবারই ককটেল ফাটে, পুলিশ আসে, তারপর আবার আগের মতোই চলতে থাকে। কোনোদিন স্থায়ী সমাধান হয় না।”
অন্যদিকে, সামাজিক সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন—এই এলাকা দীর্ঘদিন ধরে সামাজিকভাবে বঞ্চিত। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সহিংসতা থামানো সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
নগর সমাজবিজ্ঞানী ড. আরিফ হোসেন বলেন, “জেনেভা ক্যাম্পের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নীতি দরকার। সেখানে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করলে এসব সংঘর্ষ চলতেই থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রশাসন যদি স্থানীয় নেতৃত্ব ও এনজিওদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি অনেকটা পরিবর্তন করা সম্ভব।”
সরকারের ভূমিকা ও পরবর্তী পদক্ষেপ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জেনেভা ক্যাম্পে শিগগিরই স্থায়ী পুলিশ বক্স স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া নিয়মিত অভিযান চালানো হবে মাদক ও অবৈধ অস্ত্রবিরোধী অভিযানে।
স্থানীয় সংসদ সদস্যও ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “আমরা চাই না আর কোনো নিরীহ প্রাণ এই ধরনের সংঘর্ষে হারাক। ক্যাম্পে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হবে।”
নিহতের জানাজা ও দাফন
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জেনেভা ক্যাম্পের কেন্দ্রীয় মাঠে জাহিদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত মানুষ তার জানাজায় অংশ নেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্যরা।
জাহিদের মা বিলাপ করে বলেন, “আমার ছেলেটা কোনো দোষ করে নাই। শুধু বন্ধুদের সঙ্গে ছিল, তাতেই মরে গেল!”
পরে তার মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষের এই মর্মান্তিক ঘটনাটি আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—রাজধানীর অভ্যন্তরে এমন কিছু এলাকা এখনো রয়েছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। প্রশাসনের নজরদারি ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার না করলে এ ধরনের প্রাণহানি রোধ করা কঠিন হবে।
জাহিদের অকাল মৃত্যু শুধুমাত্র একটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে না, বরং নগরজীবনের অন্ধকার এক বাস্তবতাকেও তুলে ধরেছে—যেখানে ভুল সময়ে ভুল স্থানে থাকলেই প্রাণ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়।
MAH – 13436 I Signalbd.com