
চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানির মামলায় মামার পক্ষে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন ভাগ্নে। এজলাসে বিচারকের বিভিন্ন জেরার উত্তরও দিয়েছেন তিনি। জেরা শেষে এজলাসে বিচারকের কাছে জামিন প্রার্থনা করলে বিচারক ভাগ্নেকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে প্রিজনস ভ্যানে কারাফটকে নিলে কারা অভ্যন্তরে আসামির নাম-ঠিকানা যাচাই-বাছাইকালে বেরিয়ে আসে আসামির আসল নাম ঠিকানা।
দেশের স্বনামধন্য চলচিত্রকার অমিতাভ রেজা চৌধুরির নির্মিত ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার মতো এই ঘটনা ঘটেছে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়। বুধবার যাচাই বাছাইশেষে এই আয়নাবাজি ধরা পড়ে।
কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, মামার পক্ষে কারাগারে যাওয়া আসামি মো. শামীম আহম্মেদ (২৭) যশোর সদর উপজেলা ভেকুটিয়া গ্রামের জামশেদ আলীর ছেলে। শামীম তার আপন ছোট মামা হাসানের পক্ষে প্রক্সি দিতে কারাগারে গেছেন। হাসান বড় ভেকুটিয়া গ্রামের মন্টুর ছেলে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেলার আবিদ আহম্মেদ।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৮ নভেম্বর সদরের ভেকুটিয়া এলাকার বাসিন্দা রাকিবুল ইসলামের বাড়িতে চাঁদাবাজি করতে আসেন স্থানীয় নিশানুর রহমান অন্তরের নেতৃত্বে ৭-৮ জন। এসময় রাকিবুলের কাছে পাঁচ লক্ষ চাঁদা দাবি করেন। একপর্যায়ে তাদের ওপর হামলা ও রাকিবুলের স্ত্রীর শীলতাহানীর ঘটায় তারা। ঘটনার সময় তারা নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে ৫৫ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে ভুক্তভোগী রাকিবুল চাঁদাবাজী শ্লীতহানি, হামলার অভিযোগে গত ২০২৪ সালের ৯ নভেম্বর সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এই মামলার ৫ নাম্বার আসামি হাসান। বিভিন্ন সময়ে আসামিরা আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিনে রয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল আদালতে মামলার সবাই হাজিরা দিতে আসেন। এই মামলায় আসামি হাসানের বিরুদ্ধে ৩/৪ বার আদালতে হাজিরাও দেন হাসানের ভাগ্নে শামীম। মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) শামীম আদালতে হাজিরা দিতে গেলে অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। ফলে আসামি হাসানের পরিবর্তে কারাগারে প্রেরণ করা হয় শামীমকে।
এদিকে, শামীম কারাগারে যাওয়ার পর আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং আসামির নাম, পিতার নাম, ঠিকানা যাচাইয়ের সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার কথাবার্তা অসংলগ্ন হওয়ায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ফলে কারাগারের সিস্টেমের মাধ্যমে তার ফিঙ্গার প্রিন্ট, প্রকৃত নাম মো: শামীম আহম্মেদ শনাক্ত হয়।
কারা সূত্র আরও জানিয়েছে, আসামি হাসানের পরিবর্তে কারাগারে যাওয়া শামীম জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে হাসান তার আপন ছোট মামা। মামার পরিবর্তে সে ৩-৪ বার আদালতে হাজিরাও দিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি প্রতিবেদন আকারে আদালতে প্রেরণ করেছে। এখন আদালতের নির্দেশে শামীমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং মূল আসামি হাসানের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবে বলে জানান যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেলার আবিদ আহম্মেদ। তবে বিষয়টি তদন্তধীন বলে এর বেশি জানাতে চাননি তিনি।
আদালতে ঘটনার পরিণতি
মঙ্গলবার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরা দেওয়ার সময় শামীম আদালতের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। পরে আদালত তার আচরণ ও তথ্য অসংলগ্ন পাওয়ায় তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। শামীমকে কারাগারে প্রেরণ করার পর জেলা কারাগারের সিস্টেমের মাধ্যমে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং প্রকৃত নাম শনাক্ত হয়।
কারা সূত্রে জানা যায়, শামীম স্বীকার করেছে যে সে মামার পক্ষে হাজিরা দিয়েছে। এই ঘটনায় আদালত এবং কারা কর্তৃপক্ষ উভয়েই রিপোর্ট তৈরি করেছেন এবং মূল আসামি হাসানের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবে।
প্রভাব ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ঘটনাটি দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয়রা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতে আসামির পরিচয় নিয়ে কারচুপি বা প্রক্সি হাজিরা একটি গুরুতর আইনগত ব্যর্থতা নির্দেশ করে।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আদালতে হাজিরা ও কারাগারে প্রেরণ প্রক্রিয়ায় আরও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারা কর্তৃপক্ষও এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা জোরদার করার পরিকল্পনা করছে।
আইনগত দিক
মামলার আসল আসামি হাসান আদালতের নজরদারিতে থাকলেও শামীম প্রায় ৩-৪ বার মামার পক্ষে হাজিরা দিয়েছেন। আদালত তার তথ্য যাচাই করে এবং অসঙ্গতি দেখায় তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। এবার শামীমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে এবং মূল আসামি হাসানের বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হবে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, আদালত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ মতামত
আইন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসামির প্রকৃত পরিচয় মিলিয়ে নিলে আদালত ও কারা কর্তৃপক্ষের সতর্কতা কার্যকরভাবে কাজ করেছে। “এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধের জন্য আদালত এবং কারা কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক থাকতে হবে,” বলেন একজন আইন বিশেষজ্ঞ।
এদিকে সামাজিক বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন, প্রযুক্তিগতভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসামির প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে শামীম আহম্মেদকে কারাগারে প্রেরণ ও তার প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হওয়া দেশের বিচার ব্যবস্থায় সতর্কতার প্রমাণ। আদালত ও কারা কর্তৃপক্ষের যৌথ তৎপরতা এই ধরনের কারচুপির ঘটনা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে আরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।
এম আর এম – ১৯০৭,Signalbd.com