
সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক; স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে নতুন করে দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৬২ জন।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, হাসপাতালে রোগীর চাপ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৭৬২ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মোট ২৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ৬২ হাজারের বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান
বুধবার প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৯ জন, ঢাকা বিভাগের জেলা এলাকায় ১৭০ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৬০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১০০ জন, খুলনায় ৪০ জন, ময়মনসিংহে ৪১ জন, রাজশাহীতে ৩৯ জন, রংপুরে ৩ জন এবং সিলেট বিভাগে ১ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
এই তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, রাজধানী ঢাকা এখনও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকা হলেও বিভাগীয় শহরগুলোতেও সংক্রমণের হার ক্রমেই বাড়ছে।
চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি: এক নজরে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৬২ হাজার ৩৬৭ জন। এর মধ্যে ৫৯ হাজার ৪৯২ জন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌসুমি পরিবর্তন এবং অনিয়ন্ত্রিত আবর্জনা ব্যবস্থাপনার কারণে এডিস মশার বংশবিস্তার বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে নাগরিকদের সচেতনতার অভাবও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।
সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে বিপর্যয়
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এখনই কার্যকর মশা নিয়ন্ত্রণ অভিযান জোরদার না করলে আসন্ন নভেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফারহানা রহমান বলেন, “বর্ষা শেষে ডেঙ্গুর ঝুঁকি অনেক সময় আরও বেড়ে যায়, কারণ তখন পানির পাত্র বা নির্মাণাধীন স্থানে জমে থাকা পানি মশার প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়, নাগরিকদেরও নিজেদের বাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার রাখা জরুরি। প্রতিদিন ১০ মিনিট সময় দিয়ে ঘরের কোণ, ফুলের টব, পুরনো টায়ার বা পরিত্যক্ত বোতল ফেলে দিলে সংক্রমণ অনেক কমে যাবে।”
সরকারি উদ্যোগ ও সতর্কতা
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ফগিং, লার্ভা ধ্বংস ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার চালু রয়েছে এবং চিকিৎসক ও নার্সদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, “রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলেও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে নাগরিকদের সহযোগিতা ছাড়া মশা দমন সম্ভব নয়।”
এদিকে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে প্রতিটি ওয়ার্ডে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিক করণীয়
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। নাগরিকদের উচিত সপ্তাহে অন্তত একদিন বাড়ির ভেতর-বাইরের জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া, ফুলের টব ও পানির ড্রামে ঢাকনা ব্যবহার করা, এবং শিশু ও বৃদ্ধদের মশারি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
যদি কারও জ্বর তিন দিনের বেশি থাকে, সঙ্গে চোখের পিছনে ব্যথা, বমি বা রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা দেয় — তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রতিবারের মতো এবারও মশা নিয়ন্ত্রণে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি নাগরিকদের দায়িত্ববোধই পারে এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে দেশকে রক্ষা করতে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সচেতনতার এই লড়াইয়ে আমরা কতটা প্রস্তুত?
এম আর এম – ১৮৯২,Signalbd.com