
সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে চোরাচালানবিরোধী অভিযানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি টহলদলের ওপর স্থানীয় চোরাকারবারিদের হামলার ঘটনা ঘটেছে। আত্মরক্ষার্থে বিজিবি সদস্যরা গুলি চালালে আলমাস মিয়া (৩৫) নামে এক যুবক নিহত হন। বুধবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নের সুরইঘাট সীমান্ত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
ঘটনার বিস্তারিত
বিজিবি ১৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জুবায়ের আনোয়ার জানান, সকাল ১০টার দিকে সুরইঘাট বিওপির একটি টহলদল চোরাচালানবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছিল। এ সময় অবৈধ পণ্যবাহী একটি পিকআপ ভ্যান আটক করা হয়। পিকআপ আটক করার মুহূর্তে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত একদল চোরাকারবারি বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা চালায় এবং আটক করা পণ্য ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
বিজিবির দাবি, হামলাকারীদের মধ্যে কয়েকজনের হাতে ধারালো দা, বল্লম, লাঠি ও লোহার রড ছিল। তারা বিজিবির এক সদস্যকে লক্ষ্য করে আঘাত করলে তিনি গুরুতর আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি সদস্যরা চার থেকে পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় আলমাস মিয়া নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
নিহত ও আহতদের পরিচয়
নিহত যুবক আলমাস মিয়া (৩৫) জৈন্তাপুর উপজেলার নয়াখেল গ্রামের শরীফ উদ্দিনের ছেলে। স্থানীয়রা জানান, সকালে গুলির শব্দ শোনার পর তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে আলমাসকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন। পরে খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে।
অন্যদিকে, আহত বিজিবি সদস্যকে দ্রুত স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
বিজিবির সরকারি বক্তব্য
বিকেলে বিজিবি ১৯ ব্যাটালিয়নের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “সকাল ১০টার দিকে চোরাচালানবিরোধী অভিযানে অংশ নিতে সুরইঘাট এলাকায় একটি টহলদল যায়। চোরাই পণ্যবাহী একটি পিকআপ আটক করলে সশস্ত্র চোরাকারবারিরা আমাদের সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়।”
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, “হামলায় আমাদের একজন সদস্য আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে অবৈধ পণ্য ও যানবাহন জব্দ করা হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
পুলিশের তদন্ত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ
জৈন্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। পরে লাশ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।”
তিনি আরও জানান, “বিজিবি ও স্থানীয়দের বক্তব্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ঘটনাটি চোরাচালানবিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে।”
সীমান্তে চোরাচালান ও সংঘর্ষের ইতিহাস
সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলার সীমান্ত এলাকাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই চোরাচালান প্রবণতার জন্য আলোচনায় রয়েছে। ভারত থেকে পাথর, কয়লা, চুনাপাথরসহ বিভিন্ন পণ্য অবৈধভাবে দেশে আনা হয় বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। এসব চোরাচালান ঠেকাতে বিজিবি প্রায়ই অভিযানে নামে।
এর আগেও কয়েক দফা বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় চোরাকারবারিদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের আগস্টেও একই উপজেলার সীমান্ত এলাকায় অনুরূপ ঘটনায় এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
ঘটনাস্থল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, সকালে একাধিক গুলির শব্দ শোনা যায়। পরে দেখা যায়, এলাকার কিছু মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অনেক সময় নিরীহ শ্রমিক বা পথচারীরাও এসব সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যায়। তবে বিজিবি বলছে, তারা শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়েছেন।
একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, “সীমান্তে চোরাচালান বন্ধের উদ্যোগ ভালো, কিন্তু এসব অভিযানে নিরীহ মানুষের ক্ষতি হলে সেটি দুঃখজনক। প্রশাসনকে আরও সতর্কভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
বিজিবি জানিয়েছে, ঘটনাটি তদন্তে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হবে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনও আলাদা তদন্ত করছে। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে যদি কোনো অভিযোগ আসে, তা আইন অনুযায়ী বিবেচনা করা হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একইসঙ্গে সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত টহল জোরদার করা হয়েছে, যাতে পুনরায় এমন ঘটনা না ঘটে।
সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তের এ ঘটনা আবারও সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। চোরাচালান রোধের পাশাপাশি স্থানীয় জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগই পারে সীমান্ত অঞ্চলের এ ধরনের সংঘর্ষ বন্ধ করতে।
এম আর এম – ১৮৯১,Signalbd.com