
দেশের কৃষি উৎপাদন নির্বিঘ্ন রাখতে সরকার সৌদি আরব, মরক্কো ও রাশিয়া থেকে মোট ১ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন সার কেনার অনুমোদন দিয়েছে। বুধবার (২২ অক্টোবর ২০২৫) সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে শিল্প ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সার আমদানির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, যার সবগুলোই অনুমোদন পেয়েছে।
সৌদি আরব থেকে ইউরিয়া সার আসবে
শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সৌদি আরবের সাবিক এগ্রিকালচারাল নিউট্রিশন কোম্পানি থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কেনা হবে। এটি হবে ৫ম লটের আমদানি।
এই সার কেনায় ব্যয় হবে ১৫১ কোটি ৭৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭৬০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মেট্রিক টন ইউরিয়ার দাম পড়ছে ৪১৩.৩৩ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের কৃষিতে ইউরিয়া সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ধান, গম, ভুট্টা, সবজি এবং ফলের বাগানসহ প্রায় সব ফসলেই ইউরিয়া অপরিহার্য। দেশীয় উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিবছর সরকারকে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া আমদানি করতে হয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ছয়টি ইউরিয়া সার কারখানা আছে। তবে কারিগরি ত্রুটি, গ্যাস সরবরাহ সমস্যা এবং রক্ষণাবেক্ষণজনিত কারণে সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা সীমিত। ফলে সার সংকট এড়াতে বিদেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা এখনো বেশ বেশি।
মরক্কো থেকে আসছে ডিএপি সার
বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রস্তাব অনুযায়ী মরক্কোর বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওসিপি নিউট্রিক্রপস থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সার কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এটি হবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও ওসিপি’র মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির সপ্তম লট।
মরক্কো থেকে এই সার আনতে ব্যয় হবে ৩৬০ কোটি ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মেট্রিক টনের দাম দাঁড়াবে ৭৩৫.৩৩ মার্কিন ডলার।
ডিএপি (Di-Ammonium Phosphate) সার ফসলের শিকড় গঠনে সাহায্য করে এবং ফুল ও ফল উৎপাদন বাড়ায়। এই সার বিশেষ করে রবি মৌসুমে গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর, ছোলা, সরিষা ইত্যাদি চাষে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, মরক্কো বিশ্বের অন্যতম বড় ফসফেট উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে মরক্কো থেকে ডিএপি সার আমদানি করছে। এর মান ভালো ও কার্যকারিতা বেশি হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা এই সার ব্যবহারে অভ্যস্ত।
রাশিয়া থেকে এমওপি সার আমদানি
রাশিয়া থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন এমওপি (Muriate of Potash) সার আমদানির প্রস্তাবও অনুমোদন পেয়েছে।
এই চুক্তি হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিএডিসি ও রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায়। এটি হবে পঞ্চম লটের আমদানি।
রাশিয়া থেকে এমওপি সার আনতে ব্যয় হবে ১৫২ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। প্রতি মেট্রিক টনের দাম পড়বে ৩৫৬.২৫ মার্কিন ডলার।
এমওপি সার মাটিতে পটাশ সরবরাহ করে যা গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, ফলের গুণগত মান উন্নয়ন এবং পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে সবজি, ফলমূল ও ধান চাষে এই সারের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পটাশের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকায় এবার তুলনামূলকভাবে কম খরচে এই সার পাওয়া যাবে, যা সরকারের জন্য ইতিবাচক।
বরগুনায় ১০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষম বাফার গোডাউন
শুধু সার আমদানিই নয়, সরকার সার সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য নতুন অবকাঠামো উন্নয়নের দিকেও নজর দিচ্ছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩৪টি বাফার গোডাউন নির্মাণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে বরগুনায় ১০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষম একটি নতুন গোডাউন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এম/এস এমবিএল-আরএফএল, এবং এতে ব্যয় হবে ৫১ কোটি ৭৩ লাখ ৯৪ হাজার ২৯৫ টাকা।
এই গোডাউন নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের সার পেতে সুবিধা হবে। আগে যেখানে সার সরবরাহে বিলম্ব হতো, নতুন গুদামগুলো তৈরি হলে তা অনেকাংশে দূর হবে বলে আশা করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
সারের পর্যাপ্ত সরবরাহে সরকারের উদ্যোগ
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৬০-৬৫ লাখ মেট্রিক টন সার ব্যবহার হয়। এর মধ্যে ইউরিয়া, ডিএপি, এমওপি এবং টিএসপি সারই প্রধান।
দেশীয় উৎপাদনের ঘাটতি পূরণে সরকার প্রতিবছর বিদেশ থেকে প্রায় ২৫-৩০ লাখ টন সার আমদানি করে থাকে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশজুড়ে সার সরবরাহ মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠানামা এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে কিছু সময় চাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
তাই আগামী মৌসুমে যাতে কৃষকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সার পেতে পারেন, সে জন্যই এই আমদানিগুলো আগাম অনুমোদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
কৃষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
কৃষকরা বলছেন, সরকার যদি সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত সার সরবরাহ করতে পারে, তাহলে তাদের উৎপাদন খরচ কমবে এবং ফসলের ফলন বাড়বে।
রাজবাড়ীর এক কৃষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “গত বছর কিছু সময় সার পাওয়া কষ্টকর ছিল। এবার যদি আগে থেকেই সার মজুদ থাকে, তাহলে আমাদের ধান চাষ অনেক সুবিধা হবে।”
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফজলুল হক বলেন, “সরকারের এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার আগে আগাম চুক্তি করা হলে দেশের জন্য এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়।”
তিনি আরও বলেন, “তবে শুধুমাত্র আমদানির ওপর নির্ভর না করে আমাদের নিজস্ব সার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকলে স্থানীয় কারখানাগুলো আরও বেশি উৎপাদন করতে পারবে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
সরকার ইতিমধ্যে সার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে ডিজিটাল সিস্টেম চালু করেছে। এখন সার বিতরণে কৃষকের তথ্যভিত্তিক কার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে কেউ অতিরিক্ত সার নিতে না পারে।
অন্যদিকে, সার সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিতরণে দুর্নীতি বা অপচয় রোধে কঠোর নজরদারি চলছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী তিন বছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ৫০টিরও বেশি নতুন গোডাউন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, আগামী রবি মৌসুমের জন্য পর্যাপ্ত সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার দেশে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ, যেখানে সারের গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষকের মুখে হাসি রাখতে হলে মাঠে পর্যাপ্ত সার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সৌদি আরব, মরক্কো ও রাশিয়া থেকে ১ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন সার আমদানির এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে দেশের কৃষি খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় কমবে, ফলন বাড়বে এবং খাদ্য নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে।
সরকারের এই উদ্যোগ শুধু বর্তমান মৌসুমের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ কৃষি উন্নয়নের দিকেও একটি বড় পদক্ষেপ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
MAH – 13429 I Signalbd.com