শিক্ষা

বুধবার থেকে ক্লাসে ফিরছেন শিক্ষকরা: আন্দোলনের অবসান ও নতুন প্রত্যাশা

Advertisement

বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনের অবসান ঘটেছে। প্রায় দশ দিন ধরে টানা অনশন ও আন্দোলনের পর মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর ২০২৫) দুপুরে সরকার তাদের অন্যতম প্রধান দাবি—বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধি—মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তে শিক্ষক সমাজে স্বস্তি নেমে এসেছে, আর শিক্ষার্থীদের মুখেও আনন্দের ছাপ।

সরকার জানিয়েছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। এই ঘোষণা কার্যকর হওয়ার পর বুধবার থেকেই শিক্ষকরা আবারও শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষক নেতারা।

আন্দোলনের পটভূমি

গত ১০ দিন ধরে ঢাকার শহীদ মিনারে আমরণ অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা।
তাদের দাবি ছিল তিন দফা—

  1. ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধি
  2. চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি
  3. অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়

দীর্ঘদিন ধরে বেতন কাঠামোর বৈষম্য ও বাড়িভাড়া ভাতার অযৌক্তিক কম হার নিয়ে শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার শিক্ষক রাজধানীতে এসে শহীদ মিনার চত্বরে অবস্থান নেন।

অনশনরত একাধিক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়, এবং শিক্ষাবান্ধব সরকার হিসেবে সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া ও আলোচনার প্রক্রিয়া

দীর্ঘ আলোচনা ও উত্তেজনার পর মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি. আর. আবরারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শিক্ষকদের দাবি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতারা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

বৈঠক শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, চলতি অর্থবছর থেকেই শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের সাড়ে ৭ শতাংশ বাড়িভাড়া পাবেন।
অবশিষ্ট সাড়ে ৭ শতাংশ আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে কার্যকর হবে। অর্থাৎ মোট ১৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধি দুই ধাপে বাস্তবায়িত হবে।

শিক্ষক নেতাদের প্রতিক্রিয়া

সরকারের এই সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা দেলোয়ার হোসেন আজিজী। তিনি বলেন—

“আমরা সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। এটি আমাদের ন্যায্য আন্দোলনের সুন্দর সমাধান। আগামীকাল বুধবার থেকেই আমরা ক্লাসে ফিরব এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ দেব।”

তিনি আরও বলেন, সরকার যদি প্রতিশ্রুত সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করে, তবে ভবিষ্যতে শিক্ষক সমাজ আরও উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে।

শিক্ষার্থীদের স্বস্তি

শিক্ষক ধর্মঘটের কারণে গত ১০ দিন ধরে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ক্লাস কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটে।
বিশেষ করে এইচএসসি ও দাখিল পরীক্ষার্থীরা দারুণ উদ্বেগে ছিলেন।

সরকারি সিদ্ধান্তের পর শিক্ষার্থীরা ও অভিভাবকরা এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষার্থী রিয়া রহমান বলেন—

“আমাদের ক্লাস অনেক পেছিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরছেন শুনে খুব ভালো লাগছে। আমরা চাই, আর যেন এমন পরিস্থিতি না হয়।”

শিক্ষাখাতে এমপিওভুক্তদের গুরুত্ব

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৮ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে কর্মরত প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত।
তারা দেশের মোট মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার একটি বড় অংশ পরিচালনা করেন।
এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ও ভাতা সরকারের মাসিক বাজেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তবে দীর্ঘদিন ধরে তারা সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারীদের তুলনায় বিভিন্ন ভাতা ও সুবিধায় বৈষম্যের শিকার বলে দাবি করে আসছিলেন।
বিশেষ করে বাড়িভাড়া ভাতা দীর্ঘদিন ধরে মাত্র ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যা বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধির আর্থিক প্রভাব

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ১৫ শতাংশ ভাতা বৃদ্ধিতে সরকারের উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়বে, তবে এটি একটি ন্যায্য ও মানবিক সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ও নগরজীবনের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কথা বিবেচনা করলে, এই ভাতা বৃদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গড় মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.২ শতাংশ।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষক সমাজের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গিয়েছিল।
সুতরাং সরকারের এই পদক্ষেপকে অনেকেই “দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা খাতের বিনিয়োগ” হিসেবে দেখছেন।

প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তুতি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিদ্ধান্তের পরপরই প্রজ্ঞাপন জারির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
প্রথম ধাপের (সাড়ে ৭ শতাংশ) বর্ধিত বাড়িভাড়া নভেম্বর মাস থেকেই বেতনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

এছাড়া বাকি সাড়ে ৭ শতাংশ পরের অর্থবছরের বাজেটে যুক্ত করা হবে।
সরকার চাইছে, এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে কোনো প্রশাসনিক জটিলতা না থাকে।

অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের মতামত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সামিয়া করিম বলেন—

“শিক্ষক সমাজ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের দাবি মানা মানে শুধু আর্থিক বিষয় নয়, এটি শিক্ষার মান উন্নয়নেরও একটি প্রতিফলন।”

অভিভাবক সমিতির পক্ষ থেকেও সরকারের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করা হয়েছে।
তারা বলেন, শিক্ষকরা সন্তুষ্ট থাকলে শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও চ্যালেঞ্জ

শিক্ষক আন্দোলনের অবসান হলেও, এখনও বেশ কিছু অসম্পূর্ণ দাবি ও সংস্কার প্রস্তাব বাকি রয়েছে।
অনেক শিক্ষক-কর্মচারী চান, তাদের পেনশন, চিকিৎসা সুবিধা, ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতি কাঠামো নতুনভাবে নির্ধারণ করা হোক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী মাসে একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে শিক্ষক প্রতিনিধি ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একত্রে কাজ করবেন।
এই কমিটি এমপিও নীতিমালার আধুনিকায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, ও ন্যায্য বেতন কাঠামো তৈরিতে সুপারিশ দেবে।

নতুন আশার আলো

দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও হতাশার পর সরকারের সদর্থক সিদ্ধান্তে শিক্ষক সমাজে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা ফিরে পাচ্ছে তাদের প্রিয় শিক্ষক ও নিয়মিত ক্লাস।
একটি মানবিক ও শিক্ষাবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হচ্ছে সারাদেশে।

আগামী দিনগুলোতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সরকারের মধ্যে বিশ্বাস ও সহযোগিতার সেতুবন্ধন আরও দৃঢ় হোক—এই প্রত্যাশাই এখন শিক্ষাঙ্গনের সবার।

MAH – 13408 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button