
বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই ঐতিহাসিক শুনানি শুরু হয়।
আইনি মহলে এই শুনানিকে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ এই শুনানির ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিবেশের দিকনির্দেশনা।
কারা শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন
আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত রয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন শুনানি শেষে আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়।
আবেদনকারীদের মধ্যে কারা আছেন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে আপিল করেছেন নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
তাদের মধ্যে রয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম হাফিজউদ্দিন খান, নাগরিক নেতা তোফায়েল আহমেদ, আইনজীবী জোবাইরুল হক ভূঁইয়া এবং সমাজকর্মী জাহরা রহমান।
এছাড়া নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও এই রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে পৃথক একটি আবেদন করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সূচনা
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সূচনা হয় ১৯৯৬ সালে, যখন জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয়। এর ফলে দেশের নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে।
এই ব্যবস্থা প্রথমবার কার্যকর হয় ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, যা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘাত কমিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনে বলে বহু পর্যবেক্ষক মত দেন।
বৈধতা নিয়ে আইনি লড়াই
তবে এই ব্যবস্থার বৈধতা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রিট খারিজ করে দেন।
এরপর আপিলের অনুমতি পেয়ে ২০০৫ সালে মামলাটি আপিল বিভাগে ওঠে। ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপ
এই রায়ের পর ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং ভবিষ্যতের জাতীয় নির্বাচনগুলো সরাসরি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান করা হয়।
পরদিন অর্থাৎ ৩ জুলাই এই সংশোধনী গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে তখন থেকেই শুরু হয় ব্যাপক রাজনৈতিক বিতর্ক। বিএনপি ও এর সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলো দাবি তোলে—নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। অপরদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের যুক্তি ছিল—তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং গণতান্ত্রিক ধারার পরিপন্থী।
পুনর্বিবেচনার আবেদন
২০১১ সালের ওই রায়ের প্রায় ১৩ বছর পর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রায়ের পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। তাদের যুক্তি, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানো জরুরি।
পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ১৬ অক্টোবর আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। একইভাবে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন দাখিল করেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
শুনানি শুরুর খবর প্রকাশ পাওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি ও তাদের সহযোগী দলগুলো এই শুনানিকে “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা” হিসেবে দেখছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, জনগণ আবারও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট দিতে চায় এবং এই শুনানি সেই পথ উন্মুক্ত করতে পারে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও সরকারপক্ষ বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানো মানে সংবিধান ও বিচার বিভাগের রায়ের অবমাননা। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশন এখন যথেষ্ট স্বাধীন এবং সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মামলার রায় ভবিষ্যতের রাজনীতি নির্ধারণে বড় প্রভাব ফেলবে। আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশেদুল হক বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এক সময় দেশের জন্য কার্যকর ছিল, তবে সংবিধান সংশোধনের পর এখন এটি ফেরানো কতটা সাংবিধানিক, সেটাই আদালত নির্ধারণ করবেন।”
অন্যদিকে অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “যখন জনগণ নির্বাচনে আস্থা হারায়, তখন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনই গণতন্ত্রের নিরাপদ পথ।”
জনমত ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সচেতন মহলে এ বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল বিতর্ক—কেউ বলছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়,” আবার কেউ মনে করছেন, “সংবিধান পরিবর্তন করে পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হবে রাজনৈতিক পশ্চাদপদতা।”
আদালতের পরবর্তী পদক্ষেপ
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চে বিস্তারিত শুনানি চলবে কয়েকদিন। শুনানিতে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা, পূর্ববর্তী রায় ও সংশোধনীগুলোর আইনি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হবে। আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি শুনে পরবর্তী আদেশ দেবেন।
আইনজীবীদের ধারণা, এই শুনানির রায় শুধু একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হতে পারে।
পটভূমি সংক্ষেপে
১৯৯১ সালের পর থেকে দেশে তিন দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় — ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে।
এই তিনটি নির্বাচনে সাধারণত ভোটারদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল এবং আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসা পেয়েছিল।
তবে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ অতিক্রম করে দুই বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে এই ব্যবস্থার ওপর বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২4 সালের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল সংক্রান্ত এই শুনানি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে।
সব পক্ষই এখন তাকিয়ে আছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দিকে—যেখানে শুধু একটি আইনি প্রশ্ন নয়, বরং গণতন্ত্র, সংবিধান ও জনগণের আস্থার ভারসাম্য নির্ধারণ হবে।
আদালতের রায়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে—বাংলাদেশ আবারও কি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফিরবে, নাকি বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন চলবে।
MAH – 13403 I Signalbd.com