
আফগানিস্তান থেকে গত কয়েক দশকে দেশত্যাগ করা হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের সদস্যদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে তালেবান সরকার। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি বলেছেন, যারা ফিরে আসবেন, সরকার তাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ও ব্যবসা পুনরুদ্ধারে পূর্ণ সহায়তা করবে।
হিন্দু ও শিখদের দেশে ফেরার আহ্বান দিল তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সম্প্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আফগান দূতাবাসে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। সেখানে তিনি বলেন, “যে সকল হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বী অতীতের সংঘাতের কারণে দেশ ত্যাগ করেছেন, আমরা তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। আফগানিস্তান এখন শান্তিপূর্ণ, তারা ফিরলে আমরা তাদের পুরনো সম্পত্তি ও ব্যবসা ফিরিয়ে দিতে সহায়তা করব।”
এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন ১৩ জন প্রাক্তন আফগান নাগরিক, যারা বর্তমানে ভারতে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে অনেকে জানিয়েছেন, নিজের জন্মভূমিতে ফেরার আহ্বান শুনে আবেগাপ্লুত হলেও এখনও আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়া কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে তারা সন্দিহান।
অতীতের আফগানিস্তানে হিন্দু ও শিখদের উপস্থিতি
একসময় আফগানিস্তান ছিল বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সহাবস্থানের দেশ। কাবুল, জালালাবাদ, গজনী, কন্দরহর ও হেরাত অঞ্চলে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা—প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ১৯৯০–এর দশক থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ, তালেবান উত্থান এবং বিদেশি হস্তক্ষেপে ধীরে ধীরে এই সম্প্রদায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
বর্তমানে আফগানিস্তানে মাত্র ৫০ জনের মতো হিন্দু ও শিখ নাগরিক রয়েছেন বলে জানা গেছে। তারা কাবুল ও জালালাবাদের কয়েকটি গুরুদোয়ারা ও মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করে ধর্মীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে দ্বিধা ও উদ্বেগ
প্রবাসে থাকা আফগান হিন্দু ও শিখদের অনেকেই মনে করেন, তালেবান সরকারের আহ্বান শুভ ইঙ্গিত হলেও দেশে ফিরে যাওয়া এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। আফগান হিন্দু-শিখ ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি হরভজন সিং বলেন, “জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। আমরা জন্মভূমিকে ভালোবাসি, কিন্তু যদি ফেরার পর আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়, তবে সেটা আত্মহত্যার সামিল।”
তিনি আরও জানান, বর্তমানে কাবুলে কারতে পারওয়ান ও গুরু হর রাই সাহিব নামে দুটি গুরুদোয়ারা টিকে আছে, জালালাবাদে একটি গুরু নানক দরবার এখনও সক্রিয়। সারা দেশে একমাত্র হিন্দু মন্দির হিসেবে রয়েছে কাবুলের আশামাঈ মন্দির।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও তালেবান সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
তালেবান সরকার ২০২১ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশে ফেরার আহ্বানকে অনেকে সেই প্রচেষ্টারই অংশ হিসেবে দেখছেন। আফগান-বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তালেবান নিজেদের ‘সহনশীল ও পরিবর্তিত চেহারা’ তুলে ধরতে চাইছে, বিশেষত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন দাবি করছেন আমির খান মুত্তাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আফগানিস্তানে শিব ও বিষ্ণু মন্দির স্থাপনের কথা বলেছেন। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, ভিডিওটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভুয়া ভিডিও। ফ্যাক্ট-চেকাররা নিশ্চিত করেছেন যে, তালেবান সরকারের এমন কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
ধর্মীয় সহনশীলতার বার্তা না কূটনৈতিক কৌশল?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক মহলে ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবাধিকারের নতুন ইমেজ তুলে ধরতে চায়। আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশে ফেরার আহ্বান সেই কৌশলেরই অংশ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক রাশিদ আহমেদ বলেন, “তালেবান বুঝতে পারছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়া তাদের অর্থনীতি টিকবে না। তাই তারা এখন শান্তি, সহনশীলতা ও পুনর্মিলনের বার্তা দিতে চাচ্ছে। তবে কেবল আহ্বান নয়, বাস্তব নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেই প্রবাসী সম্প্রদায়ের আস্থা ফিরবে।”
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তবে আশা রয়ে গেছে
বর্তমানে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে এখনো ভয় ও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তবে সরকারের এমন আহ্বান যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দেশটির বহুত্ববাদী ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার পথে এটি হতে পারে একটি ইতিবাচক সূচনা।
বিশ্লেষকদের মতে, পরবর্তী পদক্ষেপে যদি তালেবান সরকার হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা ও সম্পত্তি রক্ষায় বাস্তব ব্যবস্থা নেয়, তবে আন্তর্জাতিক সমাজে তাদের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও বদলাতে পারে।
তালেবান সরকারের এই আহ্বানকে অনেকে একধরনের রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এটি আফগানিস্তানে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তবে বাস্তবতা হলো—নিরাপত্তা ও আস্থার পরিবেশ তৈরি না হলে প্রবাসী আফগান হিন্দু-শিখদের ফেরা এখনো অনেক দূরের স্বপ্ন।
এম আর এম – ১৮৫৬,Signalbd.com