
নেতানিয়াহুর নির্দেশে রাফাহ সীমান্ত বন্ধ, মানবিক সংকটে গাজা
গাজা উপত্যকা ও মিসরের মধ্যবর্তী একমাত্র স্থলপথ রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং আবারও বন্ধ ঘোষণা করেছে ইসরাইল। শনিবার (১৮ অক্টোবর) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, নিহত ইসরাইলি পণবন্দীদের লাশ হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত এই সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের ফলে গাজার সাধারণ মানুষ, আহত ব্যক্তি, ওষুধ, খাদ্য এবং মানবিক সহায়তা পাঠানো কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
নেতানিয়াহুর এই ঘোষণা আসে ঠিক সে সময়ে, যখন মিসরে অবস্থিত ফিলিস্তিনি দূতাবাস জানিয়েছিল—রাফাহ সীমান্ত সোমবার থেকে পুনরায় খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরাইলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় যে, সীমান্ত এখনই খোলা হবে না। ফলে আবারও অনিশ্চয়তায় পড়েছে হাজারো ফিলিস্তিনি পরিবার, যারা এই পথেই গাজা থেকে পালাতে বা সাহায্য পেতে চেয়েছিল।
রাফাহ সীমান্ত: গাজার একমাত্র শ্বাসপ্রশ্বাসের পথ
রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষের জন্য একমাত্র আন্তর্জাতিক গেটওয়ে। এখান দিয়েই মিসর থেকে গাজায় ওষুধ, খাদ্য, জ্বালানি এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রবেশ করে। গাজা যেহেতু ইসরাইল দ্বারা স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে অবরুদ্ধ, তাই রাফাহই ছিল মানবিক সহায়তার একমাত্র রাস্তা।
এই সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাজার হাসপাতালগুলোতে ওষুধের সংকট তীব্র হচ্ছে। অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অভাবে সেবা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, যদি দ্রুত সীমান্ত না খোলা হয়, তাহলে গাজায় নতুন করে মহামারি ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হামাসের কড়া প্রতিক্রিয়া
নেতানিয়াহুর ঘোষণার পরপরই ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস এক বিবৃতি প্রকাশ করে জানায়, এটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। হামাসের মতে, ইসরাইল এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে।
হামাসের বিবৃতিতে বলা হয়, রাফাহ সীমান্ত বন্ধ রাখার কারণে ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও যেসব পণবন্দীর লাশ রয়েছে, তাদের উদ্ধার ও শনাক্ত করার কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। এতে শুধু মানবিক সংকটই বাড়বে না, বরং শান্তি আলোচনার পথ আরও জটিল হয়ে উঠবে।
পণবন্দী বিনিময় চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ
চলতি মাসের শুরুতে মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় হামাস ও ইসরাইল একটি আংশিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। সেই চুক্তির অংশ হিসেবে হামাস ২০ জন জীবিত ইসরাইলি পণবন্দীকে মুক্তি দেয়। বিনিময়ে ইসরাইল প্রায় ২০০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিল।
কিন্তু কয়েকদিন না যেতেই উভয় পক্ষ একে অপরকে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগে দোষারোপ করতে শুরু করে। ইসরাইল বলছে, হামাস এখনো কিছু ইসরাইলি নাগরিককে গোপনে আটকে রেখেছে। অন্যদিকে হামাসের দাবি, ইসরাইল বোমা হামলা বন্ধের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং মানবিক সহায়তা বন্ধ করে যুদ্ধবিরতিকে অকার্যকর করেছে।
মানবিক সহায়তা আটকে গেছে সীমান্তে
রাফাহ সীমান্ত বন্ধ থাকায় মিসরের পাশে শত শত ট্রাক আটকে আছে, যেগুলোতে রয়েছে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। মিসরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরাইল সীমান্ত খুলে না দিলে এই ট্রাকগুলো গাজায় প্রবেশ করতে পারবে না।
জাতিসংঘের মানবিক দফতর জানিয়েছে, গাজা এখন এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাজার হাজার আহত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি, কিন্তু চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে চিকিৎসকরা অসহায়। অনেকে ওষুধের অভাবে মারা যাচ্ছেন।
একই সঙ্গে হাজারো গৃহহারা পরিবার এখন রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ায় দুর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এটি কেবল রাজনৈতিক নয়, একটি মানবিক বিপর্যয়ও।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
রাফাহ সীমান্ত বন্ধের ঘটনায় জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, “রাফাহ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া মানে গাজাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা।” তিনি অবিলম্বে সীমান্ত খুলে মানবিক সহায়তা চালু করার আহ্বান জানান।
মিসর সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা গাজাবাসীদের একা ফেলে দিতে পারি না। কিন্তু ইসরাইলের অনুমতি ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই।” তিনি আরও জানান, রাফাহ সীমান্তে ৩০০-রও বেশি ট্রাক আটকে রয়েছে, যেগুলোতে গাজাবাসীদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী রয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যেন মানবিক সহায়তার পথ বন্ধ না করা হয়। তবে ইসরাইলি সরকার তাদের অবস্থানেই অনড়—তারা বলছে, যতক্ষণ পর্যন্ত নিহত পণবন্দীদের লাশ ফেরত না আসছে, সীমান্ত খোলা সম্ভব নয়।
গাজার মানুষের কান্না ও অসহায়তা
রাফাহ সীমান্ত বন্ধের খবর শোনার পর গাজার বিভিন্ন এলাকায় হতাশার ঢেউ বয়ে গেছে। অনেক পরিবার যারা সীমান্তে এসে আশায় বসেছিল, তারা এখন ফের অন্ধকারে ডুবে গেছে।
এক ফিলিস্তিনি নারী বলেন, “আমার ছোট বাচ্চাটি অসুস্থ। আমি ভেবেছিলাম মিসরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবো। কিন্তু এখন সীমান্ত বন্ধ। আমাদের বাঁচার কোনো রাস্তা নেই।”
গাজার এক যুবক জানান, “আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি। আকাশে ড্রোন, চারপাশে ধ্বংসস্তূপ। রাফাহই ছিল আমাদের একমাত্র পথ। এখন সেটিও বন্ধ।”
নেতানিয়াহুর যুক্তি ও ইসরাইলের অবস্থান
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, রাফাহ সীমান্ত খুলে দেওয়া এখন নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে। তার দাবি, হামাস এখনও সীমান্তের আশপাশে অস্ত্র মজুত রাখছে এবং সুযোগ পেলে ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালাতে পারে।
তিনি আরও বলেন, “আমাদের নাগরিকদের লাশ ফেরত না আসা পর্যন্ত কোনো আলোচনা হতে পারে না। যারা আমাদের মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের প্রতি দয়া দেখানো সম্ভব নয়।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তার ডানপন্থী সমর্থকদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। তবে এতে ইসরাইলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্বের চোখ এখন রাফাহ সীমান্তে
বর্তমানে রাফাহ সীমান্ত শুধু গাজা নয়, গোটা বিশ্বের নজরকাড়া এক কেন্দ্রবিন্দু। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই সীমান্ত খুলে না দিলে গাজার অর্ধেকের বেশি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। শিশুমৃত্যুর হার বাড়বে, হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
বিশ্বজুড়ে শান্তিকামী মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় #OpenRafah হ্যাশট্যাগে আন্দোলন চালাচ্ছে। তারা বলছে, “রাজনীতি নয়, মানবিকতা আগে।”
কিন্তু বাস্তবে এখনো সেই আহ্বান ফলপ্রসূ হয়নি। সীমান্তে নিরবতা, গাজায় কান্না, আর বিশ্বজুড়ে অসহায় প্রার্থনা—এই তিনটিই যেন এখন ফিলিস্তিনের বাস্তব চিত্র।
রাফাহ সীমান্তের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। ইসরাইলের নিরাপত্তা যুক্তি যেমন দৃঢ়, তেমনি মানবিক বাস্তবতাও ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক মহল শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানালেও বাস্তবে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে।
গাজার মানুষ আজও অপেক্ষায়—কবে খুলবে সীমান্ত, কবে আসবে সাহায্য, কবে ফিরবে শান্তির ভোর।
MAH – 13402 I Signalbd.com