প্রযুক্তি

আমাজন ক্লাউড বিভ্রাট: বিশ্বজুড়ে অনলাইন সেবা বিপর্যস্ত।

Advertisement

বিশ্ব এখন পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর এক যুগে প্রবেশ করেছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বড় একটি অংশ নির্ভর করে ইন্টারনেট এবং ক্লাউড সেবার ওপর। ঠিক সেই জায়গাতেই বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্লাউড সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস (এডব্লিউএস)-এর ব্যাপক সমস্যার কারণে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ, অনলাইন ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম ও শিক্ষা সেবা একযোগে বিঘ্নিত হয়েছে।

হঠাৎ কেন বন্ধ হলো জনপ্রিয় অ্যাপ ও ওয়েবসাইট?

রবিবার রাতে এবং সোমবার সকালে বিভিন্ন দেশে ব্যবহারকারীরা লক্ষ্য করেন যে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন সেবা ঠিকভাবে কাজ করছে না। কেউ লগইন করতে পারছেন না, কেউ ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হতে পারছেন না, আবার কেউ অনলাইন লেনদেন সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
পরবর্তীতে জানা যায়, এই সমস্যার মূল উৎস হলো আমাজন ওয়েব সার্ভিসেসের সার্ভার বিভ্রাট

প্রযুক্তি পর্যবেক্ষক সংস্থা ডাউন ডিটেক্টর জানিয়েছে, সোমবার ইউটিসি সময় সকাল ৬টা ৫৬ মিনিট থেকে আমাজনের “ইউএস ইস্ট ১” অঞ্চলে সার্ভার ত্রুটি দেখা দেয়। বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী এটি ছিল দুপুর ১২টা ৫৬ মিনিট। তখন থেকেই বিশ্বজুড়ে ব্যবহারকারীরা একের পর এক সেবায় সমস্যা অনুভব করতে থাকেন।

কোন কোন সেবা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে

প্রাথমিকভাবে যেসব জনপ্রিয় অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে সমস্যা দেখা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে—

  • স্ন্যাপচ্যাট
  • ডুয়োলিঙ্গো
  • জুম
  • রোব্লক্স
  • অ্যামাজনের নিজস্ব শপিং সাইট
  • লয়েডস ও হ্যালিফ্যাক্স ব্যাংক
  • বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস প্ল্যাটফর্ম

এই বিভ্রাটের কারণে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই নয়, অনলাইন ব্যাংকিং, ই-কমার্স, এমনকি হাসপাতাল ও সরকারি তথ্যভাণ্ডারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

একই সময়ে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও সাময়িকভাবে সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

ব্যবহারকারীদের ক্ষোভ ও আতঙ্ক

সকালে হঠাৎ অ্যাপ বা ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখো ব্যবহারকারী হতবাক হয়ে পড়েন। সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। অনেকে লিখেছেন, “আজ সকালে অনলাইন ক্লাসে ঢুকতে পারছিলাম না, পরে জানতে পারলাম আমাজনের সার্ভার ডাউন।”
আরেকজন টুইট করেছেন, “আমার ব্যাংকের ওয়েবসাইটে লগইন হচ্ছিল না, আমি ভেবেছিলাম হ্যাক হয়েছে!”

এই আতঙ্কের পেছনে কারণও আছে। কারণ, অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের গুরুত্বপূর্ণ ডেটা, গ্রাহকের তথ্য এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম এডব্লিউএসের সার্ভারে সংরক্ষণ করে থাকে। ফলে সার্ভার ডাউন মানে পুরো সিস্টেম অচল হয়ে যাওয়া।

ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমাণ

এডব্লিউএসের এই সমস্যার কারণে হাজার হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের অনলাইন লেনদেন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্র তিন ঘণ্টার এই বিভ্রাটে বিশ্বব্যাপী কয়েক শ’ কোটি ডলারের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে। বিশেষ করে বড় উৎসব বা প্রোমোশনাল বিক্রির সময় এমন বিভ্রাট হলে ব্যবসায়ীদের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়।
এছাড়া, যারা ভিডিও মিটিং প্ল্যাটফর্ম বা অনলাইন ক্লাসের ওপর নির্ভরশীল, তাদের কার্যক্রমও ব্যাহত হয়।

কী বলছে আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস

আমাজনের ক্লাউড বিভাগ জানিয়েছে, তারা দ্রুত সমস্যাটি শনাক্ত করে পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, “সার্ভারের একটি অংশে অবকাঠামোগত ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। আমরা সেটি সমাধানের জন্য একাধিক বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন সেবা পুনরুদ্ধারের ইতিবাচক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।”

যদিও সংস্থাটি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছু সময় লাগতে পারে বলে সতর্ক করেছে।

কেন এমন হয়?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক বিশ্বে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের ডেটা সংরক্ষণ ও পরিচালনার জন্য ক্লাউড সেবার ওপর নির্ভরশীল।
আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস, মাইক্রোসফট আজুর ও গুগল ক্লাউড — এই তিনটি সংস্থা বিশ্বের ৭০ শতাংশের বেশি ক্লাউড সেবা নিয়ন্ত্রণ করে।

তবে এই কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার একটি বড় ঝুঁকি হলো — কোনো একটি অঞ্চলের সার্ভারে সমস্যা দেখা দিলে সেটির প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ বাঁচাতে একটিমাত্র ক্লাউড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে, ফলে বিকল্প সার্ভার না থাকায় তারা সহজেই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।

বাংলাদেশে প্রভাব

বাংলাদেশেও এই বিভ্রাটের প্রভাব পড়েছে বলে জানা গেছে। বেশ কিছু ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা ও অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্মে সাময়িক সমস্যা দেখা দেয়।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান জানান, “আমাদের অনলাইন লার্নিং সিস্টেম আমাজনের ক্লাউডে চলে। সোমবার দুপুরে প্রায় এক ঘণ্টা সেবা বন্ধ ছিল, পরে ধীরে ধীরে ঠিক হয়।”

একইভাবে কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ই-কমার্স ওয়েবসাইটও ধীর গতির সমস্যায় পড়েছে।

ক্লাউড নির্ভরতার ঝুঁকি

এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো, একক ক্লাউড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।
প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকল্প সার্ভার বা ব্যাকআপ ব্যবস্থা রাখতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় ডেটা সেন্টার ব্যবহার বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।

তারা আরও বলেন, ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে আরও বড় ধরনের ক্লাউড বিভ্রাট হয়, তবে তা শুধু ব্যবসা নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাতেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

পুনরুদ্ধার ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

আমাজন জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যেই সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করেছে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে উন্নত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করবে।
তারা বলেছে, “আমরা বুঝি আমাদের গ্রাহকদের ব্যবসা ও বিশ্বাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নতুন নিরাপত্তা স্তর এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যাকআপ সিস্টেম সংযোজন করা হবে।”

সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য পরামর্শ

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্যও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন—

  1. গুরুত্বপূর্ণ ডেটা শুধুমাত্র ক্লাউডে নয়, নিজের ডিভাইসেও সংরক্ষণ করুন।
  2. একাধিক ইমেইল বা অনলাইন একাউন্টের সঙ্গে আলাদা সিকিউরিটি ব্যবহার করুন।
  3. জরুরি যোগাযোগ ও কাজের জন্য বিকল্প প্ল্যাটফর্ম রাখুন।
  4. আর্থিক লেনদেনের সময় কোনো সমস্যা দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।

আমাজনের এই সাম্প্রতিক ক্লাউড বিভ্রাট গোটা পৃথিবীকে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে—
প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, পুরোপুরি নির্ভরশীলতা কখনোই নিরাপদ নয়।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি যদি বিকল্প ব্যবস্থা এবং স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতের এমন বিপর্যয় অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।

MAH – 13401 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button