
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ থামার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর (২০২৫) ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। কেবল গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৯৪২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আর মৃত্যুবরণ করেছেন আরও চারজন।
চলতি বছরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান
সোমবার (২০ অক্টোবর) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ৫২৩ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় ভর্তি হয়েছেন ৪১৯ জন।
এর ফলে চলতি বছরের মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৭৯১ জন। একই সময়ে নতুন করে চারজনের মৃত্যু হওয়ায় দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪৯ জনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের শেষভাগে এসে সংক্রমণের হার কিছুটা কমার কথা থাকলেও আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন ও দীর্ঘস্থায়ী বর্ষণের কারণে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে।
কোথায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখনো ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, এবং বাড্ডা এলাকায় আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি।
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চলেও ডেঙ্গুর বিস্তার দেখা যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, “আগে মূলত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা যেত। কিন্তু এখন প্রায় সারা বছরই রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এটি আমাদের জন্য উদ্বেগের।”
কারা বেশি ঝুঁকিতে
ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে।
তবে চিকিৎসকরা বলছেন, দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসার কারণেই মৃত্যুর হার বাড়ছে। অনেকেই প্রথমে জ্বরকে সাধারণ ভাইরাস জ্বর ভেবে অবহেলা করেন, যা পরবর্তীতে জটিল আকার নেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাসিমা আক্তার বলেন,
“ডেঙ্গু জ্বর এখন আর শুধু মৌসুমি সমস্যা নয়। এটি এখন সারাবছরের স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগটি দ্রুত শনাক্ত ও পর্যাপ্ত পানি পান এবং বিশ্রামই বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায়।”
সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের পদক্ষেপ
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, নিয়মিত ফগিং ও লার্ভিসাইড স্প্রে কার্যক্রম চলছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল স্প্রে নয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধিই ডেঙ্গু প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।
সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় প্রতিনিধি ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে “ডেঙ্গু প্রতিরোধ টিম”। তারা প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে জমে থাকা পানি ও ফুলের টব, ড্রাম, ডাস্টবিন, নির্মাণাধীন ভবনের পাশে পানির জমা জায়গাগুলো পরিদর্শন করছেন।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, অনেক জায়গায় এসব কার্যক্রম অনিয়মিত।
বাসিন্দারা বলছেন, কেবল স্প্রে করলেই হবে না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি দরকার।
ডেঙ্গুর উপসর্গ ও করণীয়
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ডেঙ্গুর প্রথম লক্ষণ সাধারণত উচ্চ জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, ও হালকা চামড়ার ফুসকুড়ি।
পরবর্তীতে প্লেটলেট কমে গেলে শরীরে রক্তক্ষরণ, বমি, কালো মল বা নাক-মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে — যা ডেঙ্গু হেমোরেজিক পর্যায়ের লক্ষণ।
চিকিৎসকদের পরামর্শ:
- জ্বর হলে নিজে থেকে ওষুধ না খেয়ে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে পরীক্ষা করান।
- প্রচুর পানি ও তরল খাবার গ্রহণ করুন।
- অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণ করবেন না।
- শরীরে কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে প্রতিরোধ
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর কোনো স্থায়ী প্রতিষেধক টিকা এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহারযোগ্য নয়। তাই প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
প্রতিরোধে যা করা যায়:
- ঘরের ভেতর ও বাইরে কোথাও পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না।
- ফুলের টব, কলসি, পুরোনো টায়ার, ড্রাম, ফ্রিজের ট্রে নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।
- জানালায় মশারি বা নেট ব্যবহার করতে হবে।
- সকাল ও বিকেলে শিশুদের মশা থেকে বিশেষভাবে সুরক্ষা দিতে হবে।
- নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানির উৎস ধ্বংস করতে হবে।
আগের বছরের তুলনায় পরিস্থিতি ভয়াবহ
গত বছর ২০২৪ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৩ হাজার, আর মৃত্যু হয়েছিল ৩৫৭ জনের।
এ বছর এখনো অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ না আসতেই আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়নের বিশৃঙ্খলা, এবং জনসচেতনতার অভাবই এ পরিস্থিতির প্রধান কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধির আহ্বান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন,
“ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিজের বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখলেই সংক্রমণের ঝুঁকি অর্ধেক কমে যায়।”
তিনি আরও জানান, দেশের প্রতিটি জেলায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যেন দ্রুত শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় নতুন উদ্যোগ
২০২৫ সালে সরকার ‘এডিস মনিটরিং সেল’ নামে একটি নতুন ইউনিট গঠন করেছে।
এই ইউনিট প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ড্রোন ব্যবহার করে পানি জমার স্থান শনাক্ত করছে। পাশাপাশি, একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে, যেখানে নাগরিকরা ছবি তুলে ডেঙ্গুর সম্ভাব্য উৎস সম্পর্কে জানাতে পারবেন।
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থায়ী পরিকল্পনা না নিলে আগামী বছর আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
তারা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, ও বাজার এলাকাগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণ অভিযান নিয়মিত না হলে এডিস মশা দ্রুত বংশবিস্তার করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ডা. মেহেদী হাসান বলেন,
“ডেঙ্গু মোকাবিলায় একদিনের অভিযান যথেষ্ট নয়। এটি হতে হবে নিয়মিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। সরকারি সংস্থা, সিটি করপোরেশন, গণমাধ্যম, স্কুল-কলেজ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
ডেঙ্গু এখন শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সংকট।
অসচেতনতা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে এ রোগের বিস্তার ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।
তাই প্রতিটি নাগরিকের উচিত নিজ বাড়ি ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি অপসারণ করা, এবং সামান্য জ্বরকেও অবহেলা না করা।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায় —
“আমরা যদি সবাই মিলে সতর্ক থাকি, তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব। প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি মানুষের সচেতনতাই হতে পারে এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।”
MAH – 13400 I Signalbd.com