বাংলাদেশ

৯ দিন ধরে শহীদ মিনারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা, আজ আমরণ অনশনে

Advertisement

টানা নয় দিন ধরে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। শুরুতে তারা তাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য শান্তিপূর্ণ অবস্থান, প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করলেও আজ সোমবার (২০ অক্টোবর) থেকে তারা আমরণ অনশন শুরু করেছেন। সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে তারা নিজেদের প্রতি অবিচার ও অপমান বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা।

সরকারের প্রস্তাব ও শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া

গত ১৯ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রবিধি অনুবিভাগ থেকে একটি অফিস আদেশে বলা হয়, “সরকারের বাজেট সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে (সর্বনিম্ন দুই হাজার টাকা) প্রদান করা হবে।”

কিন্তু এই ঘোষণাকে “অপর্যাপ্ত ও অবমাননাকর” বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষকরা। তাদের দাবি, বাড়িভাড়া ভাতা ও চিকিৎসা ভাতা উভয়ই সরকারি চাকরিজীবীদের সমান হারে প্রদান করতে হবে এবং দীর্ঘদিনের দাবির আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে।

শিক্ষকরা জানান, সরকার বারবার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তাদের দাবি বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। তাই তারা আজ থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন, যা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত চলবে।

শহীদ মিনারে শিক্ষকদের অবস্থান

সোমবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার শত শত শিক্ষক-কর্মচারী সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় বসে আছেন। কেউ স্লোগান দিচ্ছেন— “আমরা শিক্ষক, ভিক্ষুক নই”, আবার কেউ শান্তভাবে অনশনস্থলে অবস্থান করছেন।

শিক্ষক শামসুল রহমান মিঞা বলেন, “আমরা এই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলি, অথচ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আমাদের রাস্তায় বসতে হয়— এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের পক্ষ থেকে যে ৫ শতাংশ বাড়িভাড়া দেওয়া হচ্ছে, তা বাস্তবে কোনো সহায়তা নয়। ঢাকায় কিংবা জেলা শহরে ২০০০ টাকায় এখন একটি কক্ষ ভাড়া করাও সম্ভব নয়। তাই আমরা অপমানিত বোধ করছি এবং আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই অনশন চলবে।”

দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও দাবিগুলো

বাংলাদেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা বহু বছর ধরে এমপিওভুক্ত হিসেবে সরকারের কাছ থেকে আংশিক বেতন পান। তবে সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় তাদের সুবিধা ও সুযোগ-সুবিধা অনেক কম।

তাদের প্রধান দাবিগুলো হলো—
১. বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের জাতীয়করণ
২. বাড়িভাড়া ভাতা ও চিকিৎসা ভাতা সরকারি স্কেলের সমান করা
৩. বার্ষিক ইনক্রিমেন্টে বৈষম্য দূর করা
৪. অবসর ভাতা, উৎসব ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা সরকারি কর্মচারীদের মতো প্রদান করা
৫. এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা

শিক্ষকরা মনে করেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষকরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপদ না হন।

আগের সিদ্ধান্ত ও আন্দোলনের সূত্রপাত

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা ৫০০ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। কিন্তু শিক্ষকরা তা “তামাশা” হিসেবে বর্ণনা করে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠায়— যেখানে বাড়িভাড়া ভাতা অন্তত দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়।

তবুও শিক্ষকরা বলছেন, এই অল্প পরিমাণ বৃদ্ধি কোনো সমাধান নয়। ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে একজন শিক্ষক পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খান। অথচ তাঁরা দেশের সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন নিরলস পরিশ্রমে।

ভুখা মিছিল ও পুলিশের বাধা

রোববার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে শিক্ষক-কর্মচারীরা ‘ভুখা মিছিল’ নামে একটি কর্মসূচি নিয়ে শহীদ মিনার থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু হাইকোর্ট মাজার গেটে পৌঁছালে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে মিছিল থামিয়ে শিক্ষকরা শহীদ মিনারে ফিরে এসে পুনরায় অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন।

পরে সন্ধ্যার সমাবেশে “এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট”-এর সদস্যসচিব দেলোয়ার হোসেন আজিজী ঘোষণা দেন, “আমরা আর পিছু হটব না। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আমরণ অনশন চলবে।”

তিনি আরও বলেন, “শিক্ষকরা দেশের আত্মা, কিন্তু সরকার সেই আত্মাকে অবমূল্যায়ন করছে। শিক্ষকরা যদি রাস্তায় বসতে বাধ্য হন, তা জাতির জন্য লজ্জার বিষয়।”

সরকারি প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাবনা

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে একবারে সকল দাবি পূরণ সম্ভব নয়। তবে তারা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখবেন এবং ভবিষ্যতে ধাপে ধাপে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

একজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা শিক্ষকদের দাবির যৌক্তিকতা অস্বীকার করছি না। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় ধরনের আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগছে। আলোচনা চলমান রয়েছে।”

তবে শিক্ষক সংগঠনগুলো বলছে, আলোচনা নয়— এখন সময় বাস্তব সিদ্ধান্তের।

শিক্ষক সমাজে ক্ষোভ ও সহানুভূতি

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষকরা ভিডিও বার্তা ও সামাজিক মাধ্যমে আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, “যে পেশা জাতি গঠন করে, সেই পেশার মানুষদের যদি অনশন করতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি প্রশ্নবিদ্ধ।”

রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষিকা নাজমুন নাহার বলেন, “আমরা ছাত্রদের শেখাই ন্যায়বিচার, অধিকার ও মানবতা— অথচ নিজেরাই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। সরকারের উচিত দ্রুত শিক্ষকদের সঙ্গে বসে সমাধান বের করা।”

মানবিক আবেদন ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

অনেক শিক্ষক বয়সের ভারে ক্লান্ত, কেউ কেউ অসুস্থ। দীর্ঘ সময় রোদে-বৃষ্টিতে তারা অবস্থান করছেন শহীদ মিনারের পাদদেশে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ইতোমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, যাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

তবুও আন্দোলন থামছে না। তারা বলছেন, “আমাদের দাবি ন্যায্য, আমরা মরতেও রাজি আছি, কিন্তু নতি স্বীকার করব না।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল শক্তি হলো শিক্ষক সমাজ। তাই তাদের দাবি উপেক্ষা করা মানে শিক্ষা খাতকে দুর্বল করে দেওয়া। সরকারের উচিত দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে যৌক্তিক সমাধান বের করা, যাতে শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা গত নয় দিন ধরে যে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন, তা এখন রূপ নিয়েছে আমরণ অনশনে। তারা বলছেন, এই আন্দোলন শুধু তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়— এটি শিক্ষা ব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষার লড়াই।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজকের এই অনশন শুধু একটি দাবি নয়, এটি শিক্ষা, মর্যাদা ও সম্মানের জন্য এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ। দেশের সকল শিক্ষক-কর্মচারীর চোখ এখন সরকারের দিকে— তারা দেখতে চান, শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি রাষ্ট্র কতটা শ্রদ্ধাশীল।

সংক্ষেপে

  • ৯ দিন ধরে শহীদ মিনারে অবস্থান করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা।
  • সরকারের ৫% বাড়িভাড়া ভাতা প্রস্তাবকে তাঁরা “অপর্যাপ্ত ও অপমানজনক” বলেছেন।
  • আজ থেকে তাঁরা আমরণ অনশন শুরু করেছেন।
  • শিক্ষক-কর্মচারীরা চান, শিক্ষা খাতকে জাতীয়করণ ও ভাতা সরকারি চাকরিজীবীদের সমান করা হোক।

MAH – 13399 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button