
ওয়াশিংটন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক প্রাণঘাতী হামলার পরও গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে বলে দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, তাঁর মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে, তা এখনো টিকে আছে এবং শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে।
গতকাল রোববার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি উড়োজাহাজ এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এ মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, যুদ্ধবিরতি কার্যকর আছে। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে এই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং হামাসের সঙ্গে এটি শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকে।”
ইসরায়েলের হামলা ও যুদ্ধবিরতির প্রেক্ষাপট
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা গাজায় হামাসের অবস্থানে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভিযোগ—হামাস প্রথমে তাদের সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়, যার জবাবেই এই বিমান হামলা চালানো হয়। হামলার পর ইসরায়েল আবারও যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ঘোষণা দেয়।
গাজায় হামাসনিয়ন্ত্রিত উদ্ধারকারী সংস্থা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ওই হামলায় অন্তত ৪৫ জন নিহত ও বহু মানুষ আহত হয়েছেন। তবে ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, হতাহতের সংখ্যা তারা এখনো যাচাই করছে।
ট্রাম্প বলেন, “আমরা আশা করছি এই যুদ্ধবিরতি টিকে থাকবে। হামাসের নেতৃত্ব সরাসরি এতে জড়িত নয় বলে আমরা মনে করি; কিছু বিদ্রোহী উপাদান পরিস্থিতি জটিল করার চেষ্টা করছে।”
ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, যুদ্ধবিরতির পর কিছু উত্তেজনা বা ‘উত্থান–পতন’ স্বাভাবিক বিষয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “আমরা এখনো আশাবাদী যে এটি টেকসই শান্তির পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে নতুন কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে।”
ভ্যান্স আরও জানান, হামাসকে নিরস্ত্র করতে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে একটি ‘নিরাপত্তা কাঠামো’ গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। তাঁর ভাষায়, “যদি আঞ্চলিক দেশগুলো মিলে একটি নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলে, তবে গাজায় স্থায়ী শান্তির সুযোগ আরও বাড়বে।”
দুই বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতি
গাজায় প্রায় দুই বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের পর ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর সূচনা হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যখন হামাস ইসরায়েলে এক বিধ্বংসী হামলা চালায়। জবাবে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে, যা দ্রুত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়।
দুই বছরের এই সংঘাতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ৬৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। গাজার বিশাল অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার ৭০ শতাংশ অবকাঠামো এখন বসবাসের অযোগ্য।
ট্রাম্পের মধ্যস্থতা ও শান্তিচুক্তির কাঠামো
এই ভয়াবহ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে একটি নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বন্দী বিনিময়, মানবিক সহায়তা এবং গাজা পুনর্গঠনের একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
চুক্তিতে বলা হয়, প্রথম ধাপে উভয় পক্ষ বন্দী ও জিম্মিদের বিনিময় করবে, দ্বিতীয় ধাপে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গাজা পুনর্গঠনের কাজ শুরু হবে, এবং তৃতীয় ধাপে নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন যুদ্ধ আর না ঘটে।
তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। হামাসের কিছু অংশ এখনো অস্ত্র সমর্পণে রাজি হয়নি, এবং ইসরায়েলের ভেতরে কিছু রক্ষণশীল গোষ্ঠী এই চুক্তির বিরোধিতা করছে।
গাজায় মানবিক সংকট এখনো ভয়াবহ
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও গাজার সাধারণ মানুষ এখনো ভয়াবহ মানবিক সংকটে ভুগছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং বিদ্যুতের ঘাটতি এখনো প্রকট। জাতিসংঘের মতে, গাজার অর্ধেক জনগণ এখনো ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল।
একটি স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলে হাজার হাজার পরিবার এখনো তাঁবুতে বসবাস করছে। স্কুল ও হাসপাতালগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলো বলছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও পূর্ণ পুনর্গঠনে অন্তত ১০ বছর সময় লাগতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও, এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে তারা কিছুটা ভিন্ন অবস্থানে আছে। ট্রাম্প প্রশাসন এবার শান্তিরক্ষার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “আমরা চাই, গাজায় শান্তি ফিরুক, কিন্তু সেই শান্তি হতে হবে স্থায়ী। এজন্য সব পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।”
নতুন কূটনৈতিক উদ্যোগ
পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ইসরায়েল সফর করবেন বলে নিশ্চিত করেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স। যদিও তিনি কে তা প্রকাশ করা হয়নি, তবে ভ্যান্স নিজেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি নিজেও সফরে যেতে পারেন।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, গাজায় পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তা তদারকির জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেখানে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও যুক্ত থাকবেন।
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, ও মিসরসহ বেশ কয়েকটি দেশ যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই শান্তিচুক্তি যদি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকে, তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করবে।”
তবে কিছু দেশ এখনো সতর্ক। তারা মনে করে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে অবিশ্বাস এখনো দূর হয়নি। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিরবচ্ছিন্ন তদারকি ছাড়া এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা ও শঙ্কা
গাজার জনগণ এখন শান্তির জন্য অপেক্ষা করছে। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে মানুষ আবার নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা শুধু চাই বাচ্চারা স্কুলে ফিরুক, আর রাতের আকাশে যুদ্ধবিমানের শব্দ না শুনি।”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যতক্ষণ না ইসরায়েল ও হামাস উভয়েই একে অপরের অস্তিত্ব স্বীকার করে ও পরস্পরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, ততক্ষণ গাজায় স্থায়ী শান্তি আসবে না।
সংক্ষেপে মূল পয়েন্টসমূহ:
- ইসরায়েলি হামলার পরও গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে।
- ট্রাম্পের দাবি, তাঁর মধ্যস্থতায় হওয়া শান্তিচুক্তি এখনো টিকে আছে।
- হামাসের কিছু বিদ্রোহী উপাদান যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের চেষ্টা করছে।
- গাজায় অন্তত ৪৫ জন নিহত, বহু আহত।
- দুই বছরের যুদ্ধে ৬৮ হাজার ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে।
- গাজা পুনর্গঠন ও বন্দী বিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
- যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
গাজায় দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর এই যুদ্ধবিরতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে। যদিও চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে, তবু শান্তির পথে এগিয়ে যেতে হলে সব পক্ষকেই কূটনীতি, সংযম ও মানবতার পথ বেছে নিতে হবে।
MAH – 13395 I Signalbd.com